সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্য জগতে ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে পরিচিত। রবীন্দ্র পরবর্তী বাঙ্গালি সাহিত্য জগতে তিনি্ই একমাত্র লেখক যিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প নাটক সহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় পদচারণ করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের এর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ কুড়িগ্রাম জেলায়। মা হালিমা খাতুন এবং সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এর আট সন্তানের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। ব্যাক্তি জীবনে তিনি মনেরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হক এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুল থেকে সৈয়দ শামসুল হক এর শিক্ষাজীবন শুরু। তিনি ১৯৫০ সালে কুড়িগ্রাম ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল তিনি ডাক্তার হবেন। কিন্তু তিনি মুম্বাই পালিয়ে যান। সেখানে তিনি এক বছরের মত সময় একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার সহকারি হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন সেখান থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। স্নাতক তৃতীয় বর্ষে থকাকালীন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেননি।
“আমর ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিযাছে, তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে” কবি সৈয়দ শামসুল হক রচিত প্রথম পদ। যখন তাঁর বয়স এগারো-বারো বছর। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘উদয়াস্ত’ ছোটগল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত অগত্যা পত্রিকায়।
মধ্যবিত্তের জীবনকথা উঠে এসছে সৈয়দ শামসুল হক এর লেখায়। উঠে এসছে তাঁর লেখায় সমসাময়িক সময়কালের বাংলাদেশ। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে । আাঞ্চলিক ভাষার কবিতাকে তিনি করেছেন জনপ্রিয়। ‘পরানের গহীন ভেতর’ তাঁর রচিত অত্যাধিক জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ তাঁর রচিত সুদীর্ঘ কবিতা। যা তাঁকে এনে দেয় আদমজী পুরস্কার। কবি এবং লেকখ হিসেবে তিনি অণুকরনীয়।
চলচ্চিত্রের জন্য তিনি চিত্রনাট্য, কাহীনি, সংলাপ লিখেছেন। পেয়েছেনে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর রচিত গান ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস রঙ ফুরালেই ঠুস’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়। ১৯৭১ সালে পাড়ি জমান লন্ডনে বিবিসি বাংলার সংবাদ পাঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপনের খবরটি তিনি পাঠ করেছিলেন।
নাটকের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত তাঁর অত্যাধিক জনপ্রিয় কাব্যনাট্য। ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে তাঁর রচিত কাব্যনাট্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন ম্যাকবেথ, টেম্পেষ্ট সহ ইত্যাদি রচনা সমুহের।
আরও পড়ুনঃ
বহুমাত্রিক লেখক আহমদ ছফা এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন মিলটন: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কবির সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রে নতুন লেখদের জন্য বিভন্ন কোর্স রয়েছে যেখানে তারা লেখালেখির কৌশল শিখতে পারে। সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যে প্রথম এ বিষয়ে লিখেন। লেখালেখির কৌশল, কিভাবে লিখতে হয় এ বিষয়ে তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘মার্জিনে মন্তব্য’ নামে কলাম লিখতেন। পরবর্তীতে কলামগুলো বই আকারে বের হয়।
লেখক আনিসুল হক বলেন, “তিনি যদি অন্য সব বাদ দিয়ে দুটো বই লিখতেন ‘পরানের গহীন ভেতর’ এবং ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ তাহলে এ দুটো বই তাকে অমর করে রাখত। তিনি যদি শুধু তার কাব্যনাট্যগুলো লিখতেন ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ তাহলেও আমরা চিরদিনের জন্য তাকে বাংলা সাহিত্যে স্মরণ করতে বাধ্য থাকতাম। তাঁর কবিতা-নাটক-কলাম সবটা মিলিয়ে যে ব্যাক্তিত্বটি দাঁড়ায় তা তুলনারহিত”।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক এ ভূষিত হন । ২০০০ সালে লাভ করেন স্বাধীনতা পুরস্কার।
সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক ২০১৬ সালে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পাশে তিনি শায়িত আছেন। তিনি আছেন প্রতি বাঙালির পরানের গহীন ভেতর।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া