সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই রাতুল তার মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। সে প্রথমেই দেখলো তার নোটিফিকেশন বারে পাঁচটি আনরিড নোটিফিকেশন দেখাচ্ছে। নোটিফিকেশন চেক করে সে দেখলো, তার রাতে শেয়ার করা পোস্টে ১৫ জন রিয়েক্ট দিয়েছে। তার দুইজন বন্ধুও সেখানে কমেন্টে করেছে। এগুলো দেখে সে খুশি হয়ে তাদের কমেন্টেও মজার রিপ্লাই দেওয়া শুরু করলো। রিপ্লাই দেওয়া পর তাদের পাল্টা রিপ্লাইয়ের জন্য সে অপেক্ষা করতে করতে তার ফেসবুক নিউজফিড স্ক্রল করা শুরু করলো এবং এভাবে সে হারিয়ে গেলো স্টিমুলেশন এর রাজ্যে।
এই গল্প যদি আপনার সাথে মিলে যায় এবং আপনি এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চান, তাহলে এই আর্টিকেল আপনার জন্য। এখানে আমরা লেখক থিবো মেউরিস (Thibaut Meurisse) এর লেখা ‘ডোপামিন ডিটক্স’ বইয়ের মূল বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। তিনি বইটিতে বর্তমান সমাজে মানুষের সোশাল মিডিয়া আসক্তির কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
ডোপামিন হলো একটি নিউরোট্রান্সমিটার যা আমাদের কোনো কিছু করার মাধ্যমে বা কোনো কিছু করার ইচ্ছার মাধ্যমে, আমাদের মধ্যে ভাল লাগার অনুভূতি তৈরি করে। যেমন বাসায় কোনো মজার জিনিস রান্না হলে আপনি সেটার ঘ্রাণ পেয়েই আপনার খিদার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং খাওয়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। এই ইচ্ছা বা ভাল লাগার অনুভুতিই তৈরি হয় ডোপামিন নিঃসরণের জন্যে।
ডোপামিন নিঃসরণ মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু বর্তমানে এই ডিজিটাল যুগে অধিক ডোপামিন নিঃসরণ মানুষকে নানা বিষয়ের প্রতি আসক্ত করে তুলছে। তার একটি উদাহরণ হলো সোশাল মিডিয়া আসক্তি। এই আসক্তির ফলে মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনের কাজ গুলো সঠিকভাবে করতে পারছে না।
শুরুতে উল্লেখ করা রাতুলের ঘটনার সাথে অনেকেই হয়তো মিল খুঁজে পাবেন। সত্যি বলতে বর্তমানে জনপ্রিয় যেসব সোশাল মিডিয়া রয়েছে সেগুলো এমনভাবেই ডিজাইন করা হচ্ছে যাতে মানুষকে আরো আসক্ত করে তোলা যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ফেসবুকের একটি নতুন ফিচার ‘ফেসবুক ওয়াচ’। আপনি যদি ফেসবুক এপ ব্যবহার করেন তাহলে দেখবেন, আপনি আপনার হোম পেজে আসা একটি ভিডিওতে ক্লিক করলে আপনাকে ফেসবুকের ওয়াচ অপশনে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর আপনি একটু স্ক্রল করলেই দেখবেন একের পর এক ভিডিও আপনার সামনে আসছে আর আপনি সেগুলো একের পর এক দেখে যাচ্ছেন। আর এভাবেই আরো নানাভাবে সোশাল মিডিয়া গুলো আপনার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে আপনার ফোকাস সরিয়ে নিচ্ছে।
সবার দৈনন্দিন জীবনেই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে। হোক সেটা পড়ালেখা থেকে শুরু করে ফুল টাইম জব করা। এই সব কাজে প্রয়োজন হয় ফোকাসের।
কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সকলেরই ফোকাস করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যেমন আপনি যদি অনেক্ষণ ফেসবুক চালিয়ে এসে আপনার কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করতে যান, তখন দেখবেন আপনি সম্পূর্ণ মনোযোগের সাথে কাজ করতে পারছেন না। এর কারণ হলো মোবাইল ব্যবহারের সময় আপনার ব্রেন থেকে ডোপামিন নির্গত হচ্ছিল মানে আপনার ব্রেন সুখী অবস্থায় ছিল।
কিন্তু যখন আপনি মোবাইল ব্যবহার রেখে পড়তে বসলেন বা কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করতে গেলেন তা আর আপনার ব্রেনের কাছে আনন্দদায়ক ছিল না। তাই আপনি সেই কাজটি আর মনোযোগের সাথে করতে পারবেন না।
Thibaut Meurisse তার বইয়ে ডোপামিন ডিটক্স করার কয়েকটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। যেগুলো অনুসরণ করলে আপনি আপনার লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেকটা সাহায্য পাবেন। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো:
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন আপনার ফেসবুক স্ক্রল করতে বা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে খুব বেশি ভাল লাগে এবং এটা আপনার অন্য প্রধান কাজে বাঁধা দিচ্ছে। তাহলে সেটা নিজে উপলব্ধি করুন বা বেশি ভাল হয় সেগুলো আপনি একটি কাগজে লিখুন। এতে আপনার মস্তিষ্কে সেটার ইম্পেক্ট বেশি পরবে।
ধরুন পড়ালেখা বা কাজ করার সময় আপনার মোবাইল চালানোর ইচ্ছা হতে পারে। তাই সেটা আর আপনার মাঝে বাঁধা তৈরির জন্য আপনি আপনার মোবাইলটি অন্য রুমে রেখে আসতে পারেন। এছাড়া কোনো বিশেষ অ্যাপের প্রতি আপনার আকর্ষণ বেশি থাকলে তা হোম স্ক্রিনের এমন জায়গায় রাখুন যাতে সহজে ক্লিক না করা যায়। এছাড়া আপনার ফেসবুক ব্যবহারে আসক্তি থাকলে ফেসবুক এপ আনইন্সটল করতে পারেন এবং বেশি প্রয়োজন হলে ব্রাউজার থেকে ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে ছোট ছোট বাঁধা তৈরি করার মাধ্যমে আপনি আপনার আসক্তির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারেন।
এই স্টেপটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সাধারণত ডিস্ট্রেকটেড হয়ে যাই কারণ আমাদের যেই প্রধান কাজ গুলো থাকে সেগুলোকে প্রাধান্য দেই না। অথবা কাজগুলোর সঠিক রুটিন থাকে না। তাই আমাদের উচিত সকালে ঘুম থেকে উঠেই, আমরা পুরো দিনে কি কি কাজ (টাস্ক) সম্পন্ন করতে চাই তার একটা লিস্ট তৈরি করে ফেলা। এতে আমাদের ব্রেন সর্তক হয়ে যাবে এবং অন্য কিছুতে ডিস্ট্রেকশন এর পরিমাণ কমে যাবে। আর চেষ্টা করতে হবে যাতে দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সকালে করে ফেলার। এতে কাজটি যেমন সুন্দর ও সহজে হয়ে যাবে তেমনি ডিস্ট্রেকটেড হওয়ার সম্ভবনাও কম থাকবে।
আমরা দৈনিক কি পরিমাণ বা কত সময় আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করি আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। এতে যেটা হয় সেটা হলো, আপনি যদি প্রয়োজনের অধিক সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন তাহলে সেটাও আপনি উপলব্ধি করতে পারেন না।
তাই, আপনি যদি এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে থাকেন তাহলে ফোনের সেটিংস অপশনে Digital Wellbeing নামে একটি অপশন খুঁজে পাবেন। সেটা থেকে আপনি দেখতে পারবেন দৈনিক কত ঘণ্টা কোন এপস ব্যবহার করেছেন এবং মোট স্ক্রিন অন টাইম কত ছিল।
এতে আপনি বুঝতে পারবেন কোন অ্যাপ ব্যবহার আপনার কমানো উচিত। আপনি চাইলে কোন অ্যাপ দৈনিক কি পরিমান ব্যবহার করবেন তার সময় সিলেক্ট করে দিতে পারেন। এতে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর আপনি আর সেই অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন না।
এভাবে প্রতিদিন অল্প অল্প করে যদি আপনি উপরের নিয়ম গুলো মেনে চলে আপনার ডোপামিন ডিটক্স করতে পারেন তাহলে এক পর্যায়ে আপনার এই সোশাল মিডিয়া আসক্তির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যাবে।
মন্তব্য লিখুন