বর্তমানে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি আশংকাজনক হারে বেড়েছে ডেঙ্গু জ্বর এর প্রকোপ। দেশজুড়ে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক রোগী এ দুটির একটি কিংবা একইসাথে দুটি রোগেই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এমতাবস্থায় করোনার সাথে ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কেও সচেতনতা তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি রোগ ডেঙ্গু। স্ত্রী এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে এ জ্বরের সৃষ্টি। এডিস মশার কামড়ের ৩ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। বেশ কয়েক প্রকারের এডিস মশকী ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে থাকে। এদের মধ্যে এডিস ইজিপ্টি অন্যতম। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের ১১০ টিরও বেশি দেশে এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রথম আলোচনায় আসে ১৭৭৯ সালে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই এ ভাইরাসের উৎস এবং সংক্রমণ সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া যায়। যদিও বর্তমানেও এ ভাইরাস সম্পর্কে আরও পরিপূর্ণ ধারণা পেতে বিভিন্ন গবেষণা চলমান রয়েছে।
সাধারণত ডেঙ্গু সংক্রমণকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এগুলো হলঃ
এ পর্যায়ে ১০৪° বা প্রায়ই এর বেশি জ্বরও থাকে। শরীরে লাল ফুসকুড়ি বা র্যাশ হতে দেখা যায়। অনেকের নাক ও মুখ থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায় সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়।
এ পর্যায়ে দুই একদিন তীব্র জ্বর থাকে। গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায় যা থেকে বিকলতাও সৃষ্টি হতে পারে। ৫% এরও কম রোগীর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং হেমারেজ ঘটতে পারে।
আরোগ্য পর্যায়ে রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটতে শুরু করে। এ সময়ে সারাদেহে চুলকানি থাকে। হৃদস্পন্দনের গতি এ পর্যায়ে ধীর হতে পারে। এছাড়াও পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ক্লান্তির অনুভূতি থাকে।
গত বছর থেকে ধরে নেয়া হচ্ছে ডেঙ্গু লিভারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে করে আরোগ্য পর্যায়ের ৫ থেকে ৭ দিন রোগীর খাওয়ার রুচি থাকেনা, দুর্বল বোধ করে ,বমি হয়।
এখন অবধি ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো স্বীকৃত ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয় নি। এটি থেকে সুরক্ষিত থাকতে সচেতনতাই প্রধান অবলম্বন। এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার ঘটে।
এ কারণে মশা নিধনে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এডিস মশা ৪/৫ দিনের জমে থাকা বৃষ্টির পানি বা পরিষ্কার যেকোনো পানিতে বংশ বিস্তার করে। তাই বর্ষা মৌসুমে বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
পরিত্যক্ত পাত্র বা ফুলের টবে পানি জমে আছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।এ মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায়। তাই দিনে ঘুমাতে গেলেও মশারী ব্যবহার করতে হবে।
আশেপাশে ডোবা বা নালা থাকলে সেখানে মশা নিধনকারী স্প্রে প্রয়োগ করতে হবে। মোট কথা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে চাইলে মশার কামড় থেকে নিরাপদ থাকতে সচেষ্ট হতে হবে।
জুলাই থেকে দেশে কোভিড সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই অবস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু জ্বর এর প্রকোপ। এমন অনেক রোগীও প্রতিনিয়ত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে যারা একইসাথে কোভিড এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।
বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। এ বছর এ সময়টায় করোনার প্রকোপও বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভীড়ও আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে ৪টি হাসপাতালকে শুধুমাত্র ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্যই আলাদা করে দেয় সরকার।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪০৫ জন। এদিকে চলতি বছর কেবল জুলাই মাসেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২২৮৬ জন। রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে।
কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুতে একই সময়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জ্বর, মাথা ব্যথা, গলা বা শরীর ব্যথা নিয়ে আসা রোগীদের চিকিৎসকরা দুটো পরীক্ষাই করতে বলছেন। সাধারণ উপসর্গগুলো অনেকাংশে একই রকম হলেও এ দুই সংক্রমণকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার মত কিছু লক্ষণও রয়েছে।
করোনা আক্রান্ত হলে যেসব উপসর্গ ডেঙ্গু থেকে আলাদা সেসবের মধ্যে অন্যতম হল – ঘ্রাণ বা স্বাদ না পাওয়া, ডায়রিয়া এবং শ্বাসকষ্ট থাকা। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে যেসব উপসর্গ করোনা থেকে আলাদা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – চোখের পেছনে ব্যথা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, দাঁতের মাড়ি বা নাক থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে একইসাথে কোভিড এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ কোভিডে আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস আক্রান্ত হয় এবং প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পায়। আবার ডেঙ্গুর কারণে রক্তে প্লাটিলেট স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে।
অন্যদিকে কোভিডে আক্রান্ত হলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এক্ষেত্রে একই সাথে রক্তে প্লাটিলেট এবং অক্সিজেন সরবরাহ করা ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও কোভিডে ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্রের আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং সে অবস্থায় রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে বেড়ে যায়।
তবে কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গু, উভয়ের কোনোটির ক্ষেত্রেই উপসর্গ যদি গুরুতর পর্যায়ের না হয়, তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বাড়িতে যযথাযথ পরিচর্যা করলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। খেয়াল রাখতে হবে রোগীর দেহে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ এর নিচে নেমে যায় কিনা। পাশাপাশি রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা এবং রক্তক্ষরণের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গু একইসাথে হওয়ার ঘটনা আমাদের জন্য নতুন। যে কারণে এর প্রভাব ঠিক কতখানি বিস্তৃত বা এতে করে শরীরে বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় কিনা তা আমরা জানিনা। তবে সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাই পারে আমাদেরকে উভয়ের থেকেই নিরাপদ রাখতে।
মন্তব্য লিখুন