বাংলাদেশের অধিকাংশ কিশোর কিশোরীর প্রিয় বইয়ের তালিকায় বেশ উপরের দিকেই জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ “তিন গোয়েন্দা” এর স্থান। সেবা প্রকাশনীর এই কিশোর গোয়েন্দা সিরিজটি এদেশে তুমুল জনপ্রিয়।
লেখক রকিব হাসানের অনবদ্য সৃষ্টি তিন গোয়েন্দা সিরিজের বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালের আগস্টে।
“Three Investigators” নামক ইংরেজি কিশোর থ্রিলারকে এদেশের কিশোর কিশোরীদের জন্য উপযোগী করে লেখেন রকিব হাসান। এই মানুষটি পর্দার আড়ালে থেকে এদেশের শিশুদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়কে রঙিন করে তুলেছিলেন। এ বছর এই জনপ্রিয় সিরিজটির প্রকাশনার ৩৫ বছর হল।
“তিন গোয়েন্দা” এর প্রেক্ষাপট
শুরুর দিকে রকিব হাসান মূল কাহিনী Three Investigators এর বর্ণনাকে ঠিক রেখে বাংলায় রূপান্তর করে লিখতেন।
তবে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে তিনি নিজের মত করেই বিতবে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে তিনি নিজের মত করেই বিভিন্ন গল্পের অবতারণা করেন।
সেবা প্রকাশনী থেকেই তিন গোয়েন্দার আলোকে তিনি আরেকটি সিরিজও রচনা করেছেন যার নাম ছিল ‘কিশোর থ্রিলার অ্যাডভেঞ্চার’। তবে তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি।
পেপারব্যাক কপিতে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হত তিন গোয়েন্দার বিভিন্ন রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী।
ভলিউম আকারে প্রকাশিত এর একেকটি বইয়ে ৩টি করে গল্প থাকতো। তিন গোয়েন্দা নিয়ে রচিত প্রথম বই অর্থাৎ ভলিউম ১ এর তিনটি গল্প হল তিন গোয়েন্দা, কঙ্কাল দ্বীপ, রূপালী মাকড়সা।
তিন গোয়েন্দা সিরিজের প্রধান তিনটি চরিত্র কিশোর, মুসা আর রবিন। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রের ধারের শহর রকি বীচে থাকা এই তিন বন্ধুর গোয়েন্দা দলটির নামই তিন গোয়েন্দা।
মূল গল্প Three Investigators এ ছিল এমনই তিন বন্ধু। কিশোর পাশার চরিত্রটির নাম Jupiter Jones, মুসা আমানের চরিত্রের নাম Peter Crenshaw আর রবিন মিলফোর্ডের চরিত্রটির নাম Robert Andrews.
বাংলাদেশি-আমেরিকান কিশোর পাশা একটি এক্সিডেন্টে নিজের বাবা মাকে হারানোর পর থেকে চাচা চাচীর কাছে থাকছে। তার চাচা রাশেদ পাশার পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের এক পরিত্যক্ত মোবাইল ভ্যানেই তার হেডকোয়ার্টার।
দুই বন্ধু আফ্রিকান-আমেরিকান মুসা আমান এবং আইরিশ-আমেরিকান রবিন মিলফোর্ডকে নিয়েই তার শখের গোয়েন্দা দলটি।
খাদক মুসা আর চলমান বিশ্বকোষ রবিনকে নিয়ে বেশ পরিপূর্ণ একটি গোয়েন্দা দল গড়ে তুলেছে এই বাঙ্গালী কিশোরটি। শুরুর দিকের কতগুলো কেস সমাধানের পর রকি বীচে তারা পরিচিতি পেয়ে যায় খুব দ্রুত।
আস্তে আস্তে তাদের কাজের পরিধি যেমন বাড়ে তেমনি সেবা প্রকাশনী থেকে তিন গোয়েন্দা সিরিজের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুনঃ আগাথা ক্রিস্টি ‘কুইন অব ক্রাইম’ এর ১৩০তম জন্মদিন
প্রধান চরিত্রগুলোকে পূর্ণতা দিতে রকিব হাসান বেশ কয়েকটি পার্শ্বচরিত্রকেও সমান পারদর্শীতার সাথে তুলে ধরেছেন। গোয়েন্দা সহকারী হিসেবে বেশ কিছু বইয়ে দেখা মেলে জিনা আর ফারিহার।
জর্জিনা পার্কার বা জিনা চরিত্রটি রয়েছে “Three Investigators” -এও। সেখানে এই চরিত্রটি Georgina Kirrin নামে পরিচিত।
তাকে প্রথম দেখা যায় প্রেতসাধনা গল্পে। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে রয়েছে হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার যার মূল বইয়ের নাম আলফ্রেড হিচকক।
এছাড়াও রয়েছে রাশেদ পাশা আর মেরি চাচী, পুলিশ প্রধান ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, পাইলট ওমর শরীফ, প্রাইভেট গোয়েন্দা ভিক্টর সাইমন, কনস্টেবল ফগর্যাম্পারকট, শুঁটকি টেরিসহ আরও অনেকে।
প্রায় সবকটি চরিত্রই নেয়া হয়েছে Three Investigators থেকে। রকিব হাসান এবং শামসুদ্দীন নওয়াব রচিত তিন গোয়েন্দা সিরিজে রয়েছে ১৬০টিরও বেশি বই।
জনপ্রিয় এই কিশোর গোয়েন্দা সিরিজের দীর্ঘ পথচলা ছিল সাফল্য ও ভালোবাসায় ঘেরা। আমাদের দেশের অধিকাংশ কিশোর কিশোরীর জীবনের একটি সুন্দর সময়ের সাক্ষী এই সিরিজ।
২০১৫ সালের আগস্টে তিন গোয়েন্দার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিশোর ম্যাগাজিন ‘কিশোর আলো’ একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল।
তিন গোয়েন্দার ইতিহাসের পাশাপাশি সেই বইয়ে এর লেখক রকিব হাসানের একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল। দৈনিক প্রথম আলোর একটি জরিপে বাংলাদেশের কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে পাঠযোগ্য বই হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল তিন গোয়েন্দা।
পর্দার আড়ালের লেখক
তুমুল জনপ্রিয় এই সিরিজের লেখক রকিব হাসান সচারাচর মিডিয়াকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। কিশোর থ্রিলার লেখক ও অনুবাদক রকিব হাসানের জন্ম ১৯৫০ সালে,কুমিল্লায়। এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন ফেনী থেকে।
এরপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে বিএসসি শেষ করেন। রকিব হাসানের বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। যদিও তা ছিল ছদ্মনামে লেখা। স্বনামে প্রকাশিত প্রথম বইটি ছিল ব্রাম স্টোকারের বিখ্যাত বই ড্রাকুলার অনুবাদ।
এরপর ১৯৮৫ সালে সেবা প্রকাশনী থেকে তিন গোয়েন্দা সিরিজটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তিনি জাফর চৌধুরী ছদ্মনামে গোয়েন্দা রাজু সিরিজ এবং আবু সাঈদ ছদ্মনামে রোমহষর্ক সিরিজের বই লিখেছেন। এছাড়াও জনপ্রিয় বেশ কিছু ক্লাসিক বইয়ের অনুবাদক তিনি।
বিখ্যাত ক্লাসিক অ্যারাবিয়ান নাইটস এবং এডগার রাইস বারোজের রচিত টারজানের অনুবাদকও তিনি। কিশোরদের উপযোগী বেশকিছু ভৌতিক ও সায়েন্স ফিকশন বই রচনা করেছেন। শুধুমাত্র তিন গোয়েন্দা নিয়েই তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১৬০। এছাড়া কমপক্ষে ৩০টি অনুবাদ গ্রন্থ রয়েছে তার।
কৈশোরের সময়টাকে অভাবনীয় আনন্দ দেয়া এই সিরিজটি নিয়ে ২০১৪ সালে একটি টিভি সিরিজ সম্প্রচার করা হয়েছিল। তবে আজকালকার কিশোর কিশোরীরা অনেকেই তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তার কথা জানেনা।
একটা সময়ে এই সিরিজের একেকটি বইয়ের জন্য এদেশের কিশোররা কি অধীর আগ্রহে থাকতো, তা সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা নেই। সেবা প্রকাশনীর বিখ্যাত এ সিরিজটি সেসময় যারা পড়েছে তারা আজও এর কথা আনন্দের সাথে স্মরণ করে।