মৃতের ডাইরী
“একটু পরেই দেখি সবাই চিৎকার করে কান্না কাটি শুরু করে দিলো। কেউ বলতেছে ছেলেটা এভাবে হটাৎ মারা গেলো… এই শব্দটুকু কানে পৌছানো মাত্রই কাদা মাটির মধ্যই আমি বসে পড়লাম। আর ভাবছি এই মানুষ গুলা কি সব পাগলের প্রলাপ শুরু করছে। আমি তো বেঁচে আছি কিন্তু এরা কেনো বলছে আমি বেঁচে নাই। আমার চেহারার মতো যে ছেলেটি কল পাড়ে পড়ে আছে। সে মারা গেছে এই খবরটি মুহুর্তের মধ্য সারা গ্রামে প্রচার হয়ে গিয়েছে। ”
মৃতের ডাইরী
রাত তখন ১২টা ৯। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই কখনও জোরে কখনও আস্তে বৃষ্টি হচ্ছিলো ওই বর্ষার সময় যেমনটা হয় । আমাদের বাড়ির চাল টিনের তৈরি হওয়ায় বৃষ্টির ফোটার আওয়াজ একটু জোরালো ও শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছিলো। আমাদের ঘরের সাথে বাথরুম সংযুক্ত ছিলো না, সাধারনত গ্রামে যেমনটা হয়ে থাকে। যেহেতু রাতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন সেহেতু বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। এ আর এমন কি এটা তো প্রতিদিনের ঘটনা। তাই মনে কোনো ভয়ের চিহ্ন না রেখে ছা নিয়েই বের হচ্ছিলাম। দরজা খুলে বাইরের ইলেকট্রিক লাইটের সুইচ অন করলাম। তারপরেও সাথে একটা টর্চ লাইট নিয়ে বাহির হয়েছিলাম।
আমাদের বাড়ি গ্রামের মধ্য হলেও কারেন্ট এর তেমন কোনো সমস্যা না হওয়ায় টর্চ লাইটের ব্যাটারি পরিবর্তন করাও তেমন প্রয়োজন হতো না।টর্চ না জ্বালিয়ে ছাতাটা মেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । যেহেতু বাড়ির সিমানা থেকে একটু দুরে বাথরুম টা তাই হাটছি আর টর্চ লাইটা জ্বালানোর চেস্টা করছি। টর্চের আলো স্পস্ট না হওয়ায় দু এক ঘা দিয়ে লাইটের আলো স্পস্ট করলাম।
সাময়িক সময়ের জন্য একটু আলো বড়লেও আবার আগের অবস্থা হয়ে যাচ্ছিল। এমনটা করছিলাম আর বাথরুমের দিকে এগিয়ে চলছি। বৃষ্টির ফোটা ছাতার ওপর পড়ে কেমন জানি একটা শব্দ তৈরি হচ্ছিলো। কিছুটা হাটতেই কল পাড়ের কাছে এসে পৌছালাম। কল পাড় যখন পার হয়ে দু পা সামনে দিছি তখন পাশের ঝোপ ঝাড় থেকে শব্দ কানে আসতে লাগলো। শব্দটা ছিলো এমন জল কাদার মধ্য ছোটো ছোটো বাচ্চারা লাফা লাফি করলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনই। মনে তখন একটু ভয়ের আভাস উদয় হলো।
ওই স্থানে একটু দাঁড়িয়ে টর্চটাকে একটু নেড়ে- চেড়ে আলো বাড়িয়ে ঝোপের ওপর পড়তেই দেখলাম ঝোপ নড়ছে। ওই মুহুর্তেই যেনো সব কিছু ভুলে কান খাড়া করে শব্দটার দিকে মনোযোগ দিলাম। যেহেতু শব্দটা অদ্ভুতুড়ে সেজন্য আমি কেনো এই রাতে বের হয়েছি তা মনে করতে না পারায় সেটা আর মনে করার চেস্টা না করে শুধু ভাবছিলাম আর নিজের কাছে প্রশ্ন করছি ব্যাপারখানা কি?শব্দটা একটু সময় পর পর শুনতে পারছিলাম না।
আবার কিছুক্ষন পর শব্দটা আগের থেকে বেশি জোরে শুনতে পারলাম।তখন যেনো ভয় পুরোপুরি ভাবে শরীর ঘিরে ধরেছে। মনে আসছে বিভিন্ন পৈশাচিক, ভৌতিক ব্যাপার কিন্তু নিজেই স্বাভাবিক থাকার চেস্টা করছি কিন্তু শব্দটা তখন আমাকে স্বাভাবিক থাকতে দিচ্ছিলো না।ভয়ার্ত মন নিয়ে টর্চের আলো দিয়ে দেখার চেস্টা করছি কি আছে ওখানে।কিছুক্ষন পর একটু সময়ের জন্য দেখতে পেয়েছি চার পায়ের কোনো জন্তু জানোয়ার।
আরও পড়ুনঃ ছোট গল্পঃ “প্রথম গুলি, প্রথম রক্ত, প্রথম শহীদ”
অবাক করা বিষয় হলো প্রাণীটার কোনো মাথা দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো না ।মনের মধ্য তখন এমন হচ্ছিলো যেনো আত্মারাম এই বুঝি বের হয়ে গেলো। বৃষ্টির বেগ একটু বেড়ে গেলো। ভয়ে তাড়াহুড়া করে ঘরের দিকে যেতেই ঘটে গেলো এক অবাক করা ঘটনা। কলপাড়ের একটু ঢালু যায়গায় পা পড়তেই পিছলে পড়ে যাই এবং কলঘরের পাকা মেঝের ওপর মাথা পড়েছে। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো তখন এতো কস্ট হচ্ছিলো মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছিলো না এজন্যই কাউকে ডাকাতেও পারছিলাম না।
ঘটে যাওয়া ঘটনা টা একেবারেই মনে ছিলো না। মনে হচ্ছিলো দিনের আলো ফুটে গেছে। আমি যেনো চিরসুখি একটা মানুষ। আশে পাশে অনেক মানুষ তাদেরসাথে ঘুরতে ফিরতে বেশ ভালোই লাগছিলো। সারা দিন ঘোরাঘুরি হলো এবং সন্ধ্যা হলো কিন্তু ঘোরা ফেরা মোটেও শেষ হচ্ছিলো না। এভাবে সকাল হলো। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় যেয়ে দেখি কল পাড়ে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে একটু এগিয়ে দেখি মানুষ কল পাড় ঘিরে দাঁড়ায়ে আছে।
আর প্রতিটা মানুষের চোখে মুখে কেমন একটা বিষন্নতার ছাপ। সকলের চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না । কেউ বা কান্না কাটি করছিলো। মানুষের ফাক দিয়ে দেখছিলাম আমাদের গ্রামের হরিরাম মুখার্জি ডাক্টার মানুষের মাঝে বসে একজনকে পরিক্ষা নিরীক্ষা করছে। আমি একটু আগ্রহ নিয়ে একটু সামনে গিয়ে দেখি কলপাড়ে আমার চেহারার মতো একজন শুয়ে আছে। তখন আমার শিরা উপশিরা দিয়ে প্রচন্ড বেগে রক্ত বইতে শুরু করলো।
একটু পরেই দেখি সবাই চিৎকার করে কান্না কাটি শুরু করে দিলো। কেউ বলতেছে ছেলেটা এভাবে হটাৎ মারা গেলো… এই শব্দটুকু কানে পৌছানো মাত্রই কাদা মাটির মধ্যই আমি বসে পড়লাম। আর ভাবছি এই মানুষ গুলা কি সব পাগলের প্রলাপ শুরু করছে। আমি তো বেঁচে আছি কিন্তু এরা কেনো বলছে আমি বেঁচে নাই। আমার চেহারার মতো যে ছেলেটি কল পাড়ে পড়ে আছে।
সে মারা গেছে এই খবরটি মুহুর্তের মধ্য সারা গ্রামে প্রচার হয়ে গিয়েছে। আরও কিছুক্ষন পর দেখলাম গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে আর সবাই আমাদের বাড়ির দিকে আসছে।বাবাকে দেখলাম কল পাড় থেকে ওই ছেলেটাকে কোলে করে ঘরের সামনে একটা মলিন কাপড় বিছায়ে শুইয়ে দিয়েছে।ভিষন কান্নাকাটিতে ভেঙে পড়ছে। তখন আমি সেখান থেকে উঠে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছি দেখো আমি বেঁচে আছি তোমরা খালি খালি কান্নাকাটি করছো কেনো। মনে হলো প্রতিটি মানুষের কাছে গিয়েই একই কথা বলতে লাগলাম কিন্তু কেউ শুনতে পারছিলো না আমার কথা ।
চিৎকার করছিলাম কিন্তু কারোর কানেই আমার কথা যাচ্ছিলো না। এর পর হতাশ মুখে বাড়ির এক কোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতেছি কেউ আমার কথা শুনতে পারছে না কেনো। এর কিছুক্ষণ পর কেউ একজন পাশ থেকে আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে বলে আমার কথা শোনো। তখন তার দিকে তাকিয়ে আমি চিনতে পারছিলাম না। কিন্তু এতো কিছু না ভেবে তাকে বলেছিলাম দেখো কেউ আমার কথা না শুনে শুধু শুধু কান্নাকাটি করছে।
তিনি তখন হেসে দিলো। আমি তখন তার হাসি দেখে বলছিলাম দেখো আমার কথা কেউ শুনতে পারছে না কিন্তু তুমি শুনতে পেয়ে কেনো হাসছো? কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাকে বলে উঠলাম তোমাকে তো আগে কখনও দেখি নাই। তোমার পরিচয় কি? কোথা থেকেই বা এসেছো? তিনি প্রথমেই বলে রাখলো আমি যে কথা গুলা বলবো তাই শুনে বিচলিত হইয়ো না এবং তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিবো।
আমি তাকে আস্বস্থ করলাম তার কথায় বিচলিত হবো না। তিনি এবার তার পরিচয়ে বললেন তিনি নাকি আমার পূর্বপুরুষ। এই শুনে তখনই মনে কোনো প্রশ্ন আসে নাই। আমি তাকে প্রশ্ন করে বসলাম আচ্চা আমার বাড়িতে সবাই শুধু শুধু কান্না কাটি করছে কেনো?এই প্রশ্নের উত্তর আগে দাও। তিনি হেসেই উত্তর দিলো তুমি যে গতকাল মারা গেছো তাই তোমার কথা আমি ছাড়া কেউ শুনতে পারছে না। কারন আমিও এক মৃত আত্মা। তার এই কথা গুলা প্রথমেই আমি মানতে রাজি হচ্ছিলাম না।
তিনি আমাকে বললো তুমি প্রমান চাও যে তুমি এখন সাধারন মানুষ নেই? আমি সাথে সাথেই বলে উঠলাম হ্যা আমার প্রমান চাই।তিনি আমায় বললো তুমি দেখো শত চেস্টা করলেও এখানে উপস্থিত মানুষের শরীর অনুভব করতে পারবানা।তখনই আমি ছুটে গিয়ে বাবার হাত ধরতে গিয়ে ধরতে পারলাম না।এর পর তার সাথে অনকে কথার পর মেনে নিলাম আমি কাল রাতেই মারা গিয়েছি।
এভাবে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়েছে আমি এবং আমার পূর্বপুরুষ দাড়িয়ে সব দেখছি আর মনে যেমন প্রশ্ন আসছে তার কাছে প্রশ্ন করছি তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আমার মৃত দেহের পাশে আমার পরিবারের সবাই কান্না করছে। এরপর আমার মৃত দেহ নিয়ে যাচ্ছে শ্মাশানে।দেখলাম বাবাও সাথে যাচ্ছে। এটা দেখে আরেকবার অবাক হলাম এবং আমার মৃত পূর্বপুরুষের কাছে বললাম আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন বাবাকে একদিন বলেছিলাম বাবা আমার না শ্মশান খুব ভয় লাগে তাই আমি কখনও শ্মাশানে যেতে চাই না।
এমনকি গ্রামে কেউ মারা গেলে আমার বয়সের অনেকেই শ্মশান গেলেও আমি কখনই যাই নাই। পুরা ঘটনাতে আমার চোখে এক বিন্দুও জল আসে নাই। কিন্তু বাবা এই কথা জানার পরেও কেনো আমাকে শ্মাশানে নিয়ে যাচ্ছে এটা দেখে চোখের জল আটকে পারলাম না।এই ঘটনার পরে আমার পূর্বপুরুষ আমাকে একটা কথা বললেন। কথাটা হলো কারোর প্রিয় মানুষের মৃত্যু হলে তার প্রতি যে ভালেবাসা, আদর,স্নেহ থাকে সেটা বিসর্জন দিয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে সেই ব্যক্তিটাই উপস্থিত থাকে। এর পর মনটাকে শান্ত করলাম।
এভাবে কিছুদিন পর আমার কথা মনে হয় সবাই ভুলে গেছে। শুধু মা মাঝে মাঝে মনে করছে আর কান্না কাটি করছে।আবারও আমার পূর্বপুরুষকে বললাম আমি তো বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিলাম কিন্তু তাও আমার মৃত্যুটা এতো সহজে মেনে নিতে পারলো? তখন তিনি বললেন এটা সৃস্টিকর্তার আর্শিবাদ। তিনিই তোমার পরিবারকে শোকাহত করেছেন এবং তিনিই এসব কাটিয়ে ওঠার আর্শিবাদ করেছেন। আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
তখন আমার পূর্বপুরুষ বললো চলো আমাদের এবার যাওয়ার সময় হয়ছে। আমি বললাম এখন আমি কোথায় যাবো তিনি বললো আমার সাথে চলো। এই জগৎটা এখন তোমার আমার নেই। আমরা এখন সেই জগৎ এ চলে যাবো যে জগৎ এ শুধুই আমাদের। তখন তাকে বাধা দিয়ে বললাম আমি যে যাইতে পারবো না। তিনি আমার কাছে কারন জানতে চাইলেন আমি উত্তরে বলাম আমি সবসময় একটা বন্ধুর পাশে থেকেছি ওই বন্ধুকে কথা দিয়ে ছিলাম আমি তার পাশে থাকবো সবসময়।
তখন তিনি বলছিলেন তুমি মারা গেছো। আমি তার সকল কথাতেই বিশ্বাস করেছি এবং মেনেছি। কিন্তু আমি এই জগৎ থেকে যেতে কোনো মতেই রাজি হয় নাই। তিনি আমাকে বুঝালেন এবং বললো তোমার কথা তোমার বন্ধুরা কিছুদিন মনে করবে একসময় হয়তো ভুলে যাবে তোমায়। এইরকম শুধু তোমার বন্ধুরা না এইরকম করবে তোমার পরিবারের লোকও।
তিনি আরও বললো তুমি যাদের সাহয্য করেছো সবসময় পাশে থেকেছো তারা তোমার সামান্য উপকারের কথাও কোনোদিন মনেরাখবে না। আমি তখন বললাম সে ভালো আমাকে মনে রাখবে। তখন তিনি বললেন যদি তোমার কথা আনেকদিন পরে একদিনও মনেকরে আর তোমার ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করে তাহলে তোমাকে আবার এই পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিবো। আবার তোমার জীবন শুরু হবে ১২টা ৯ থেকে। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে রওনা হলেন সেই নতুন জগৎ এর পথে।
আর তিনি আনমনে বলে উঠলেন তুমি জীবনে শেষ বারের মতো ১২ টা ৯ এর সময় ঘরথেকে বের হয়ছো। এরপর কয়েক দশক হয়ে গেলো এখনও পৃথিবীতে ফিরতে পারলাম না। হয়তো সবাই আমাকে চিরদিনের জন্য ভুলে গেছে। সব শেষে বুঝতে পারলাম আমি যে কখনও পৃথিবীতে আর ফিরতে পারবো না সেটা আমার পূর্বপুরুষ জানতো।
গল্পের ভাষাগুলো সহজ এবং সুন্দর ছিল।