কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম একটি সমুদ্র সৈকত। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার এটি একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে একই সাথে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা যায়।
আজ কথা বলবো সাগরকন্যা হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের অন্যতম এই সমুদ্র সৈকতের নজরকাড়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,যাতায়াত এর নিয়ম সহ যাবতীয় বিষয় নিয়ে।
সমুদ্র সৈকতের অবস্থানগত বর্ণনা
১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নৈসর্গিক এই সমুদ্র সৈকতটি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপালী ইউনিয়নে অবস্থিত।
ঢাকা থেকে স্থল পথে এর দূরুত্ব ৩৮০ কিলোমিটার এবং বরিশাল শহর থেকে প্রায ১০৮ কিলোমিটার। ২০১১ এর আদমশুমারি অনুসারে ৯০৭৭ জন জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই এই সংখ্যা বর্তমান সময়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে।
এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্য কুয়াকাটাকে সকল সমুদ্র সৈকত থেকে অনন্য হিসেবে গড়ে তুলেছে।
সূর্যোদয় সবচেয়ে ভাল দেখা যায় সৈকতের পূর্ব প্রান্তের গঙ্গামতির বাঁক থেকে। আর সূর্যাস্ত দেখার ভাল জায়গা হচ্ছে কুয়াকাটার পশ্চিম সৈকত।এসব জায়গায় কিভাবে যাতায়াত করা যায়,সে বিষয়ে পরে আসছি।
সৈকতের এক পাশে রয়েছে বিশাল সমুদ্র আর অন্য পাশে রয়েছে নারিকেল গাছের সারি। কুয়াকাটার পরিচ্ছন্ন বেলাভূমি, অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্র সৈকত, দিগন্তজোড়া সুনীল আকাশ এবং ম্যানগ্রুভ বন কুয়াকাটাকে দিয়েছে এক অপরূপ সৌন্দর্য। ওপাড়ে তাকালে সুন্দরবনের ভারতের অংশ দেখতে পাওয়া যাবে।
কুয়াকাটা নামকরণের ইতিহাস
কুয়াকাটা নামের পেছনে রয়েছে এক দারুণ ইতিহাস। ‘কুয়া’ শব্দটি এসেছে বাংলা ‘কূপ’ শব্দ থেকে। ধারণা করা হয় যে ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হযওয়ার পর বার্মিজ আরকানরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তখন এখানে পানির অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়া বা কুপ খনন করেছিলেন।অসংখ্য কুপ খনন করায় কুয়ার জন্য এই এলাকা বিখ্যাত হয়ে উঠে। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা!
দর্শনীয় স্থানসমূহ
১। কুয়াকাটা বৌদ্ধ মন্দির
মন্দিরের সৌন্দর্য আপনাকে স্বাভাবিকভাবেই বিমোহিত করবে।এখানে রয়েছে পুরাতন বৌদ্ধ মূর্তি।এছাড়া বোর্ডিং এ থাকা অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও দেখা পাবেন আপনি।
২। ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী নৌকা
কুয়াকাটার মূল কুয়ার সামান্য পাশেই রয়েছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেখার জন্য শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী নৌকা।এই নৌকা শুধুমাত্র উন্নত কাঠ দিয়ে তৈরী।
বিশালাকার এই নৌকা দেখে তখনকার সময়ের বাংলার নৌ প্রকৌশল যে সময়ের সাথে বেশ তাল মিলিয়ে চলতো,সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে যাবেন।
৩। কুয়াকাটার কুয়া
কুয়াকাটা যাবেন,বিখ্যাত সেই কুয়া দেখবেন না তা কি হয়?কুয়কাটার বিখ্যাত সেই কুয় বরাবর ই দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকে।কুয়াটি তারজালি দিয়ে পরিবেষ্টিত রয়েছে।কোনো ডিভাইস দিয়ে ছবি তোলার সময় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ থাকলো।
৪। কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান
কুয়াকাটার জাতীয় উদ্দ্যানে ঘুরে নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে বাধ্য হবেন।
৫। কাউয়ার চর
কুয়াকাটা যাবেন,অথচ কাঁকড়া দেখবেন না সেটা তো হয়না।কাউয়ার চড়ে গেলে আপনি দেখতে পাবেন সারি বাধা হাজার হাজার লাল কাঁকড়া।আপনার পদচারণায় কাঁকড়াগুলো টুপ করে তাদের বাসায় লুকিয়ে পড়বে।মনোরম এই দৃশ্য দেখতে হলে অবশ্যই যেতে হবে কাউয়ার চড়ে।বিচে বাইক ভাড়া পাওয়া যায়।সেটা ব্যবহার করে যেতে পারেন।
৬। চর গঙ্গামতী
ছবি তোলার জন্য সুন্দর একটা জায়গা এটা।ভ্রমণের তালিকায় এই জায়গাটি অবশ্যই রাখবেন।
৭। ঝাউ বন
ঝাউ গাছ সমুদ্র তীরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতেরও সেই অনন্য বৈশিষ্ট্যটি রয়েছে।এটাও ছবি তোলার অনেক উপযুক্ত একটা স্থান।
৮। লাল কাঁকড়ার চর
এখানেই আপনি কাউয়ার চড়ের মত সারি সারি কাঁকড়ার বিচরণ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবেননা।
৯। রূপালী দ্বীপ
রূপালী দ্বীপে আমি ব্যক্তিগতভাবে যেতে পারিনি জন্য বিস্তারিত বলতে পারছিনা। তবে,ভ্রমণ পিপাসুদের তালিকায় এটা থাকবেই।তাই,বাদ যেন না পড়ে যায় আপনার ভ্রমণের এই অংশটি!
১০। বৌদ্ধ বিহার
বৌদ্ধ বিহারের সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত করবে।এটি মিশ্রিপাড়ায় অবস্থিত।
১১। মিষ্টি পানির কূপ
সুপেয় পানির এরকম আধার যে থাকতে পারে এরকম উপকূলীয় এলাকায়,না দেখলে আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে।সুপেয় পানির অন্যতম আধার এই কূপ।
১২। রাখাইন পল্লী
রাখাইন পল্লী শপিংপ্রেমীদের হতাশ করবেনা।রাখাইনরা পরিপাটি করে দোকান খুলে বসেছে বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী,খাদ্য মামগ্রী নিয়ে।রাখাইনদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগটাও আপনি রাখাইন পল্লীতে গিয়ে পেয়ে যাবেন।
১৩। শুঁটকি পল্লী
শুটকি মাছের উৎকট গন্ধ অনেকেই সহ্য করতে পারেনা কিন্তু শুটকিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য না বললে ভুল হবে জায়গাটিকে।হরেক রকমের নাম জানা এবং না জানা মাছের পশরা নিয়ে দোকান দেখা যায় এখানে।আপনার পছন্দের শুটকি মাছটি সহজেই কিনে নিতে পারেন এখান থেকে।
১৫। ঝিনুক বীচ
বেশি বড় পরিসরে না হলেও এখানে ঝিনুক পড়ে থাকতে দেখতে পাবেন।বিচে বসে ঝিনুক কুড়ানোর মজাই কিন্তু আলাদা।ঝিনুক কুড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ মিস না করতে চাইলে অবশ্যই ভ্রমণ তালিকায় ঝিনুক বিচকে রাখবেন।
১৬। লেবুর চর
স্থানীয় ভাষায় জায়গাটি লিম্বুর চড় নামেও পরিচিত।সূর্যাস্ত দেখার জন্য উপযুক্ত একটা জায়গা।
১৭। তিন নদীর মোহনা
সাগর আর নদী যেখানে মিলে যায়,তাকেই ভৌগলিক পরিভাষায় মোহনা বলে।তিনটা নদী এসে সমুদ্রের সাথে মিশে গিয়েছে- অপরূপ এই দৃশ্যটি অবলোকনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন না কিন্তু।
১৮। সুন্দরবনের পূর্বাংশ (ফাতরার বন)
ফাতরার বনে ঘুরতে গেলে দল বেধে যাবেন। গ্রুপ ছবি তোলার জন্য সুন্দর একটা জায়গা।সুন্দরবনে ঘোরার সুযোগ কখনো না হলেও এখানে ঘুরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারবেন আর কি।
কুয়াকাটা যেভাবে যাবেন
১. লঞ্চযোগে
ঢাকা থেকে লঞ্চে করে বরিশাল এসে নামতে হবে।এরপর বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে মাহিন্দ্রা/সিএনজি যোগে বরিশালের অন্যতম স্থান রূপাতলী বাস্ট্যান্ডে আসতে হবে।সেখান থেকে সরাসরি কুয়াকাটার গাড়িতে উঠতে পারবেন।
২. বাসযোগে
ঢাকা থেকে কুয়াকাটার সরাসরি বাস রয়েছে।সাকুরা পরিবহন এর এসি এবং নন এসি উভয় গাড়ি ঢাকা থেকে সরাসরি বরিশালে চলাচল করে।এসির ভাড়া বর্তমানে ১১০০ টাকা, নন এসি ৬৫০ টাকা। অনেকে গ্রীন লাইন বাসে চলাফেরা করে অভ্যস্ত।সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে বরিশাল বাসযোগে এসে পরবর্তীতে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে কুয়াকাটার বাস ধরতে পারেন।
আর,কুয়াকাটার মধ্যে ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে পারেন।খরচ কমাতে চাইলে বাইক ভাড়া করে সব জায়গায় যেতে পারেন।নিকটবর্তী এলাকায় যেতে ইজিবাইক,ভ্যান সবই পেয়ে যাবেন আপনার হাতের কাছে।
থাকা ও খাওয়া
হোটেল/মোটেলে অবস্থান
কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের আগমণের কথা মাথায় রেখে রাস্তার দুই ধারে প্রচুর আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে। কমদামভ হোটেল থেকে শুরু করে ভিআইপি ক্লাস- সবধরণের হোটেল ই আপনি পেয়ে যাবেন।
খাওয়া দাওয়া
খাওয়া দাওয়ার জন্যও অসংখ্য হোটেল পেয়ে যাবেন আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি।তবে,চিরায়ত খাবারের থেকে বিচে ঘুরতে যেয়ে সবাই সামুদ্রিক খাবারের প্রতিই বেশি ঝোঁক প্রদর্শন করে।এক্ষেত্রে কাঁকড়া ফ্রাই,রূপচাদা ফ্রাই,টোনা ফ্রাই এসব টেস্ট করার পরামর্শ থাকলো।
আরও পড়ুনঃ ছাত্রজীবন থেকেই শুরু হোক ফ্রিল্যান্সিং
সাগরকন্যা হিসেবে সুখ্যাত কুয়াকাটার সুখ্যাতি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াব্যপী।নিজের দেশের মনোমুদ্ধকর এই সমুদ্র সৈকতটি ভ্রমণ না করলে আপনার জীবনে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেকটাই অদেখা থেকে যাবে।
পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই। সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণের সময় আবর্জনা ফেলবেন না। সমুদ্র সৈকতকে পর্যটকদের উপযুক্ত করার দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের না, আপনার এবং আমারও।
ছবি: সংগৃহীত