আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটে যাওয়া সকল দৃশ্যমান ঘটনা গুলো ক্লাসিকাল মেকানিক্স বা চিরায়ত বলবিদ্যা এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু আমাদের এই পরিচিত জগৎ ছাড়াও আরও এক ধরনের জগৎ রয়েছে অণু-পরমাণুর জগৎ।
এই অণু-পরমাণুর জগতে বস্তুর অবস্থান,অস্তিত্ব এবং এর প্রভাব এক ধরনের অস্পষ্টতার মাঝে বিরাজ করে। যে কারণে চিরায়ত বলবিদ্যার সূত্র এ জগতের ঘটনা গুলো ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।
তখন অণু-পরমাণুর জগৎ বা কোয়ান্টাম জগৎ সম্পর্কিত সকল ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানের নতুন এক শাখার উদ্ভাবন হয় যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে পরিচিত।
বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর নিজস্ব কিছু কূটাভাস বা প্যারাডক্স রয়েছে। চলুন কিছু প্যারাডক্সিকাল কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
প্রথমেই জেনে নেই কূটাভাস বা প্যারাডক্স কি? প্যারাডক্স হচ্ছে এমন এক ধারণা যেখানে কোন সমস্যার দুটি পরস্পর বিরোধী সমাধান তৈরি হয়। অর্থাৎ একটি সত্যি হলে অপরটি কখনো সত্যি হওয়া সম্ভব নয়।
এটা এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যেখান থেকে অনন্য কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। আবার কিছু প্যারাডক্স সমাধানের জন্য জটিল গাণিতিক এবং দার্শনিক যুক্তির প্রয়োজন হয়।
সক্রেটিস এর একটা বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে “আমি শুধু জানি যে আমি কিছুই জানি না”। অর্থাৎ সক্রেটিস কি কিছুই জানতেন না? নাকি শুধুমাত্র এটা জানতেন যে তিনি কিছুই জানেন না।
এখানে প্রথম বাক্যটি সত্যি ধরে নিলে দ্বিতীয় বাক্যটি মিথ্যা হয়ে যায়। আবার দ্বিতীয় বাক্যটি সত্যি ধরে নিলে প্রথম বাক্যটি মিথ্যা হয়ে যায়। এই পরস্পর বিরোধী উক্তিটি একটি প্যারাডক্স।
এবার কোয়ান্টাম প্যারাডক্স নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
আমরা জানি যে আলো তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ। আলো কখনো তরঙ্গ হিসাবে বিরাজ করে আবার কখনো কণা হিসেবে বিরাজ করে। অর্থাৎ আলোর দ্বৈত ধর্ম রয়েছে। বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এবং আইন্সটাইনের কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী বিকিরণ বা শক্তির দ্বৈত ধর্ম রয়েছে-একটি কণা ধর্ম এবং অপরটি তরঙ্গ ধর্ম।
কিন্তু শক্তির মতো পদার্থেরও যে দ্বৈত ধর্ম রয়েছে তা ততদিন অবদি জানা ছিল না। ১৯২৪ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী লুইস ডি-ব্রগলী পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, পদার্থেরও তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে। অর্থাৎ পদার্থ কণা এবং তরঙ্গ উভয় অবস্থায় থাকতে পারে।
তিনি প্রমাণ করেন যে –“ প্রত্যেকটি চলমান কণার সাথে একটি তরঙ্গ যুক্ত থাকে”। ডি-ব্রগলী কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে পদার্থের কণা ধর্ম তথা ভরবেগের সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সম্পর্ককারী সমীকরণ বের করেন- λ = h/p
এই সমীকরণে পদার্থের দ্বৈত ধর্ম প্রকাশিত হয়েছে। এটা তরঙ্গ-কণা দ্বৈত অবস্থা বা ডি-ব্রগলী হাইপোথিসিস নামে পরিচিত। এই হাইপোথিসিস মতে – কোন তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণকে ফোটন কণা হিসেবে ধরে নিলে তা দিয়ে আলোক তড়িৎ ক্রিয়া, কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ, পারমাণবিক বর্ণালি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তথা কণা ধর্মের ব্যাখ্যা করা যায়।
কিন্তু এই তত্ত্ব দিয়ে অপবর্তন, সমবর্তন, ব্যতিচার ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য তথা আলোকীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায় না। অপরদিকে বিকিরণকে তরঙ্গ হিসাবে ধরে নিলে তা দিয়ে আলোকীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু কণা ধর্মের ব্যাখ্যা করা যায় না।
আপাতদৃষ্টিতে এটাকে পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক মনে হলেও আসলে এরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত,যা কোয়ান্টাম প্যারাডক্স এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।
১৯৩৫ সালে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর এই ধারণার উপর ভিত্তি করে আইন্সটাইন, তার দুজন সহযোগী বোরিস পোডোলস্কি এবং নাথান রোজেন মিলে পরস্পর দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত বস্তুর অবস্থা নিয়ে একটি চিন্তা পরীক্ষা করেন।
যা EPR প্যারাডক্স নামেও পরিচিত। এটা মূলত কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ধারণার বিরোধী যা পরবর্তীতে এনট্যাংগেলমেন্ট ধারণা নিয়ে আসে।
আইন্সটাইনের EPR চিন্তা পরীক্ষা মোতাবেক-ধরুন সমান ভরবেগের দুটি ইলেকট্রন পরস্পরের দিকে ছুটে এসে ধাক্কা খেলো।
এরপর ইলেকট্রন দুটি আলোর বেগের থেকে অধিক বেগ নিয়ে পরস্পরের থেকে বিপরীত দিকে ছিটকে যাবে। এক পর্যায়ে তারা পরস্পর থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে চলে যাবে। এখন যদি একটা ইলেকট্রনের স্পিন পরিমাপ করা হয় +১/২ তবে অপরটি নিশ্চিন্তে -১/২ স্পিনের হবে।
আবার প্রথমটির স্পিন -১/২ হলে পরেরটি +১/২ হবে। তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে প্রথম ইলেকট্রনটির স্পিন সংখ্যা আগে থেকেই নির্দিষ্ট ছিল। বিজ্ঞানী পাউলির থিউরি মোতাবেক “একই কোয়ান্টাম স্তরে কখনোই দুটি ইলেকট্রন একই অবস্থায় থাকতে পারে না”।
একটির স্পিন সংখ্যা +১/২ হলে অপরটি -১/২ হবে। এখানে ধনাত্মক এবং ঋণাত্নক চিহ্ন দিয়ে ইলেকট্রন এর ঘূর্ণন দিক বোঝানো হয়েছে।
তো এক্ষেত্রে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন একটির স্পিন সংখ্যা নির্ধারণ করা হচ্ছে অপরটি সম্পর্কে বলা সম্ভব নয় ।
অর্থাৎ পরস্পর থেকে আলোকবর্ষ দূরে থেকেও তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। পরস্পর দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত বস্তুর এই অবস্থাই এনট্রাংগেলমেন্ট ধারণা নিয়ে আসে। যা কোয়ান্টাম এনট্রাংগেলমেন্ট নামে পরিচিতি লাভ করে।
বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং ওয়ার্নার কার্ল হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর উপর ভিত্তি করে আণবিক পর্যায়ের বস্তুর আচরণ নিয়ে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেনশন থিউরি নামে পরিচিত ।
এই থিউরি মোতাবেক একটি কোয়ান্টাম কণা একই সাথে তার সব রকম অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ কোয়ান্টাম কণাটি একটি নির্দিষ্ট মুহুর্তে একই সাথে কণা হিসেবে থাকতে পারে অথবা তরঙ্গ হিসাবেও থাকতে পারে। কণার এই সব রকম অবস্থার সমন্বয়কে বলা হয় কোয়ান্টাম সুপারপজিশন।
কোন পর্যবেক্ষক পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত যে-কোন একটি অবস্থা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় । অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ করার আগ পর্যন্ত কণাটি একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ উভয় অবস্থায় থাকতে পারে।
কোয়ান্টাম সুপারপজিশন ব্যাখ্যা করার জন্য ১৮৩৫ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী এরউইন শ্রোডিঙ্গার দৃশ্যমান বস্তুর উপর একটি পরীক্ষা করেন যা “শ্রোডিঙ্গার ক্যাট ” নামে খ্যাত।
তিনি কোয়ান্টাম সুপারপজিশন তত্ত্ব মানলেও কোন ঘটনা যে পর্যবেক্ষক এর উপস্থিতি এর উপরও নির্ভর করে এটা মানতে পারছিলেন না। এরই ফলস্বরূপ তিনি তার এই বিখ্যাত পরীক্ষাটি করেন। এটি মূলত একটা কাল্পনিক পরীক্ষা যা শ্রোডিঙ্গার কখনো বাস্তবে রুপ দেন নি।
শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কিত একটি বহুল প্রচলিত প্যারাডক্স। যেখানে কল্পনা করা হয় একটি বিড়াল এর কথা, যাকে জীবিত অবস্থায় একটি তেজস্ক্রিয় মৌল,তেজস্ক্রিয়তা ডিটেক্টর, একটি হাতুড়ি এবং বিষভর্তি ফ্লাস্ক সমেত একটি বক্সের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে।
এবং বাইরে থেকে বক্সটি সম্পুর্নভাবে সীল করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বক্সের মধ্যে কি ঘটছে তা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। এখন যদি বক্সের মধ্যে থাকা তেজস্ক্রিয় মৌলটির বিকিরণ ঘটে তাহলে তেজস্ক্রিয়তা ডিটেক্টর এর সাথে থাকা হাতুড়িটি পড়ে যাবে এবং বিষভর্তি ফ্লাস্কটি ভেঙে যাবে।
ফলে বিড়ালটি মারা যাবে। আর যদি বিকিরণ না ঘটে তবে বিড়ালটি জীবিত থাকবে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন পর্যবেক্ষক বাইরে থেকে বক্সটি খুলে দেখছেন ততক্ষণ পর্যন্ত জানা সম্ভব নয় যে বক্সের মধ্যে কি ঘটেছিল।
তেজস্ক্রিয় মৌলটির বিকিরণ হয়েছিল নাকি হয়নি। অর্থাৎ একই সাথে বিড়ালটি মৃত বা জীবিত যে কোন অবস্থাতেই থাকতে পারে।
এখানে শ্রোডিঙ্গারের যুক্তি হচ্ছে বিড়ালটির বাঁচা কিংবা মরা নির্ভর করছে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ এর উপর। কিন্তু তেজস্ক্রিয় পদার্থ টির বিকিরণ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০/৫০। ফলে বক্সের মধ্যে বিকিরণ ঘটা বা না ঘটা দুটোরই সম্ভাবনা থেকে যায়। যেহেতু বক্সের মধ্যে কোন পর্যবেক্ষক নেই তাই বক্স না খোলা পর্যন্ত জানা সম্ভব নয় যে বিড়ালটি মৃত নাকি জীবিত।
ফলে বিড়ালের ভাগ্যে কি ঘটেছিল এটা জানার জন্য সম্ভাব্য দুটো পরিনতি কেই ধরে নিতে হবে জীবিত এবং মৃত।বিড়ালটির পরিনতি সম্পর্কিত এই সাংঘর্ষিক দুইটি সম্ভাবনাও ঠিক একই ভাবে একটি প্যারাডক্স সৃষ্টি করে।
উপরিউক্ত তত্ত্ব গুলো থেকে বোঝা যায় যে- আপাতদৃষ্টিতে প্যারাডক্সকে পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক মনে হলেও এরা আসলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ।
কোয়ান্টাম প্যারাডক্স সম্পর্কিত এই সকল তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই প্যারালাল ইউনিভার্স কিংবা টাইম ট্রাভেল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ছবিঃ সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, কোরা, সাইন্সবি, উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান।
মন্তব্য লিখুন