সম্প্রতি আয়রন ডোম আমাদের Social Media গ্রুপ গুলোতে খুব আলোচিত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে হামাসের কাঁচা হাতের রকেট গুলো আটাকানোয় বেশ কয়েকজন মানুষ এটিকে সৌরজগতের সেরা স্যাম সিস্টেম বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অনেকেই আয়রন ডোম কি তা না জেনেও মন্তব্য করছে। চলুন তাহলে আজ আমরা আয়রন ডোম সম্পর্কে জানি।
আয়রন ডোম হলো ইজরায়েলের তৈরি একটি শর্ট রেন্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম। যাকে সংক্ষেপে স্যাম-SAM বলা হয়। এর হিব্রু নাম (כִּפַּת בַּרְזֶל) -কিপাত বাজেল বা আয়রন ক্যাপ। আয়রন ডোম মূলত তৈরি করা হয়েছে স্পেশাল ভাবে হামাসের রকেট, আর্টিলারি শেল আটকানোর জন্য। বিজ্ঞান প্রেমীরা বলে থাকেন বিজ্ঞান ইজরায়েলকে রক্ষা করছে। আয়রন ডোম এটি তৈরী করেছে ইজরায়েলের রাফায়েল এডভান্স সিস্টেম এবং ইজরায়েল এ্যারো স্পেস ইন্ডাস্ট্রি।
আসলে এটির মূল শক্তি বা ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের প্রযুক্তি আমেরিকার। এমনকি এটির প্রজেক্ট বাজেট এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও আমেরিকার ডিফেন্স জায়ান্ট লকলিড মার্টিন প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে। আয়রন ডোমের প্রতিটি ব্যাটারি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ রাডার ডিটেকশন ইউনিট, ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট এবং কন্ট্রোল ইউনিট এবং মিসাইল ফায়ারিং ইউনিট।
আইরন ডোমের মিসাইলের নাম তামির। এটির প্রতিটি লঞ্চার সিস্টেমে ২০টি করে মিসাইল থাকে। যার রেঞ্জ ৭০-২৫০ কিলোমিটার।
আয়রন ডোমের প্রতিটি ব্যাটারির দাম ৫০ মিলিয়ন বলা হলেও আদৌতে ৬০-৭০ মিলিয়ন ডলার। এক ব্যাটারিতে ৩টি লঞ্চার সিস্টেম থাকে। প্রতিটি লঞ্চারে ২০টি মিসাইল থাকে। একেকটি ইন্টারসেপ্টর তামির মিসাইলের দাম ৪০০০০ ডলার বলা হলেও
এগুলোর বর্তমান দাম ৭০০০০ ডলার। বলে রাখা ভালো, প্রতিটি হামাসের ৮০০ ডলারের রকেটের বিপরীতে ইজরায়েলকে কমপক্ষে দুইটি তামির মিসাইল নিক্ষেপ করতে হয়। মানে প্রতিটি ৬৬ হাজার টাকার রকেট আটকাতে ইজরায়েলের ১১ কোটি ৬ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়।
শর্ট রেন্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম গুলোতে আয়রন ডোমকে আপনি অবশ্যই সেরা বলতে পারেন। বিশেষ করে লো অবজারবেল টার্গেট গুলোর জন্য এটি খুবই কার্যকর। তবে তা গাজা এবং ইজরায়েলের ভিতরের ক্ষেত্রে। এটি ২০১১ সালে সার্ভিসে আসে।
২০১২ সালে আয়রন ডোম প্রায় ৪০০ রকেট ইন্টারসেপ্ট করে এবং ২০১২-২০১৪ সাল পর্যন্ত আইরন ডোম প্রায় ১২০০ হামাসের রকেটকে ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়। কিছুদিন আগেও হামাস ইজরায়েলে ১৫০০ রকেট নিক্ষেপ করে। তার মধ্যে ২০০+ এর মতো রকেট আয়রন ডোম ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়।
হামাসের রকেট গুলো আটাকাতে পারার বেশ কিছু কারণ রয়েছে-
১) হামাস কোথায় থেকে রকেট গুলো উৎক্ষেপণ করবে অর্থাৎ লঞ্চ সাইট হতে পারে এরকম বেশ কয়েকটি স্থান আগে থেকেই আয়রন ডোমের ফায়ার কন্ট্রোল রাডারে সেট করে দেওয়া থাকে। যার কারণে রকেট ফায়ার করার সাথেসাথেই আয়রন ডোম একশন নিতে পারে।
২) আয়রন ডোমের রাডার রেন্জ অনেক বেশি। যার রকেট ফায়ার করার সাথে সাথেই আয়রন ডোমের রাডার খবর পেয়ে যায়। যেমন আমরা যদি আমাদের চট্টগ্রামে এস-৪০০ মোতায়েন করি ইন্ডিয়ার ভিতরে আরো ৪০০ কিলোমিটার এলাকায় মিসাইল লঞ্চ হলে আমরা জানতে পারবো।
৩) হামাসের রকেট গুলো সেকেলে আমলের এবং আল কাসাম রকেট গুলোতে কোন গাইডেন্স সিস্টেম নেই ও এটি একটি সাধারণ ধাতব পাইপ ফ্রেম দিয়ে তৈরি। এসব রকেট অত্যাধুনিক তামির মিসাইলের প্রযুক্তির তুলনায় খুবই অনুন্নত এবং রকেট গুলোর ব্যয় কয়েকশো ডলার। এগুলি অত্যন্ত ত্রুটিযুক্ত, লঞ্চের পর কোথাও আঘাত করানো, হিসাবের বিচারের চেয়ে ভাগ্যের বিষয়।
৪) আধুনিক মিসাইল গুলোকে আয়রন ডোম কতটুকু প্রতিহত করতে পারবে তা প্রশ্নবিদ্ধ! কেননা- হামাসের রকেট গুলো কোন মিসাইল নয়। আধুনিক ক্রুজ মিসাইল গুলোতে অত্যাধুনিক গাইডেন্স থাকে। এগুলো স্যাম সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে বিভিন্ন ম্যানুভার করতে পারে। এছাড়া এগুলো স্টিলেথ প্রযুক্তিও হয়ে থাকে। এবং এগুলো খুবই গতিশীল। অন্যদিকে হামাসের রকেট গুলো, গাইডেন্স কি তা চিনেই না। তাছাড়া এগুলো গতি খুবই কম। মানে লো সাবসনিক। যা তামির মিসাইলের গতির কাছে শিশু।
৫) গাজা সীমান্তে ইজরায়েল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আয়রন ডোম ব্যাটারি মোতায়েন করেছে। যেমন- যেখানে রকেট আসার সম্ভবনা ৫০টি, সেখানে ২ ব্যাটারি আইরন ডোম মোতায়ন করেছে। মানে ৫০টির বিপরীতে ১২০টি ইন্টারসেপ্টর মিসাইল রেডি রেখেছে।
৬) একটি ওয়েপনের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে ওপেন ব্যাটল গ্রাউন্ডে আসতে হবে। যেমন- আমি প্যাট্রিয়েট প্যাক ৩ এর কথা বলি। আপনি যদি আয়রন ডোমকে সেরা ডিফেন্স সিস্টেম বলে থাকেন তাহলে আপনাকে প্যাট্রিয়েট প্যাক ৩ কে তার বাপ বলতে হবে।
কেননা- সম্প্রতি সৌদি আরব এই সিস্টেম দ্বারা হুতিদের প্রায় ৮৫% মিসাইল ইন্টারসেপ্ট করেছে। হুতিদের মিসাইল গুলো ছিলো উচ্চ গতির ও গাইডেন্স যুক্ত ট্যাকটিকেল ব্যালেষ্টিক মিসাইল। এবং প্যাট্রিয়েট প্যাক ৩ রাডার উক্ত মিসাইল গুলোর লাঞ্চ সাইট সম্পর্কে না জেনেও সফল ভাবে মিসাইল গুলোকে ইন্টারসেপ্ট করে ধব্বংস করেছে।
অন্যদিকে আয়রন ডোম আগে থেকেই হামাসের রকেট লাঞ্চ সাইট সম্পর্কে জানে বা ধারণা করতে পারে। স্থান ভেদে এটা কয়েক কিলোমিটার নড়াচড়া হতে পারে।
৭) বেশ কিছুদিন আগে সিরিয়ার একটি এয়ার ডিফেন্স মিসাইল ভুলে ইজরায়েলে প্রবেশ করলে আয়রন ডোম সেটিকে ইন্টারসেপ্ট করতে ব্যার্থ হয়। এটি কিন্তু কোন ক্রুজ বা ট্যাকটিকেল ব্যালেষ্টিক মিসাইল নয়। সিরিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের এস-১২৫, বাক এসব সেকলে আমলের সোভিয়েত স্যাম সিস্টেম দিয়ে টমাহক, হারপুন এবং অনেক ইজরায়েলী AGM মিসাইল ধব্বংস করেছে। যেগুলো কিনা হামাস রকেট থেকে হাজার গুন উন্নত। এসবের ভিত্তিতে আপনি এস-১২৫ ও বাক মিসাইল সিস্টেমকেও সেরা বলবেন?
৮) হামাসের রকেট গুলোর গতিপথ আগে থেকেই বুঝা যায়। মানে এটি সরলরেখা বরাবর চলে। তাই আইরন ডোম আগে থেকেই এটির ব্যাপারে একশন নিতে পারে।
আয়রন ডোম, এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চার বিষয় এই হাতিয়ার। ইসরায়েলের এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এবং রাফাল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমের যৌথ উদ্যোগে এটি তৈরি। ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব থেকে শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দিতে সমর্থ। শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করে দিতে এটি ৯০ শতাংশ কার্যকর।
মন্তব্য লিখুন