বর্তমানে বিশ্বে মুসলিম দেশ কিংবা অমুসলিম দেশ প্রায় অধিকাংশ দেশের একটি সহজাত রীতি হলো বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা। অর্থাৎ বুঝাতে চাচ্ছি, রাষ্ট্রের রাজা-বাদশা কিংবা কোন রাষ্ট্র প্রধান মৃত্যুবরণ করলে, তার জন্য রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়ে থাকে।
তাছাড়াও আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ দেশে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা হয়ে থাকে। আর একটি দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই এটি পালন করতে যেন একপ্রকার বাধ্য । যাই হোক আমরা আজ ব্যক্তিগত কোনো কারণ বা চিন্তা নিয়ে এই প্রবন্ধটি লিখছি না। বরং এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য একটাই শারঈ দৃষ্টিতে ইসলামে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা জায়েজ কিনা? সে বিষয়ে সবার মাঝে একটি স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা। কেননা একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ে ধর্মীয় বিধান জানা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রীয় বা বৃহত্তর সার্থে কোন ফাতোয়া দেওয়া বিদগ্ধ মুফতি বা বিজ্ঞ ইসলামিক স্কলারদের কাজ। কেননা এ ক্ষেত্রে তাঁদের একটি ফাতোয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে এবং রাষ্ট্রের সবার ওপর তা প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাই আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে আমরা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদগ্ধ ফকিহ শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.) এর ফতোয়া হুবহু তুলে ধারার চেষ্টা করবো, ইন-শা-আল্লাহ।
শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.) ফতোয়া প্রদান করে লিখেছেন-
বর্তমান যুগে ইসলামী বহু রাষ্ট্রের মধ্যে এ প্রথা চালু হয়েছে যে, কোনো রাজা বাদশাহ বা রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যু হলে ৩ দিন বা তাঁর চাইতেও কম অথবা এর চাইতেও বেশি দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অফিস আদালত বন্ধ করা এবং পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ কাজটি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শরী’য়াত বিরোধী কাজ। এ ছাড়াও কাজটি ইসলামের শত্রুদের অনুকরণ ও অনুসরণও বটে।
এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বহু সহীহ হাদীস এসেছে, যে সমস্ত হাদীসে এ জাতীয় শোক পালন নিষেধ করা হয়েছে এবং এমন কাজ থেকে তাঁর যেন বিরত থাকে, এ ব্যাপারে উম্মাতকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। তবে স্ত্রী তাঁর স্বামীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন শোক পালন করবে।
এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে নারীদের জন্য আরেকটি বিশেষ অনুমতি রয়েছে যে, তারা তাদের নিকট আত্মীয়ের কারো মৃত্যু হলে, তাঁর জন্য ৩ দিন বা এর চাইতে কম সময় শোক পালন করতে পারবে। এ ছাড়া অন্য কোনো প্রকার শোক পালন আমাদের ইসলামী শরী’য়াতে নিষিদ্ধ।
আমাদের এ শরী’য়াত তথা মানুষের জন্য মহান আল্লাহর দেওয়া পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থায় কোনো বাদশাহ বা রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান বা অন্য কারো জন্য কোনো প্রকার শোক পালন করা অর্থাৎ শার’ঈ দৃষ্টিতে ইসলামে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা জায়েজ হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবদ্দশায় তাঁর ছেলে ইবরাহীম এবং ৩ মেয়ে এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ মারা যান। তাদের জন্য তো তিনি শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেননি। আর তাঁর সময়েই মুতার যুদ্ধের বীর সেনাপতিগণ যেমন যাইদ ইবন হারেসা, জাফর ইবন আবু তালিব, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহুম শহীদ হয়েছিলেন। তিনি তাদের কারো জন্যে কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেননি।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.), যিনি মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং আদম সন্তানদের মধ্যে তিনি সর্বজন সম্মানিত ব্যক্তি, দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় মসিবত। এরপরও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাঁর জন্য কোনো প্রকার শোক দিবস পালন করেননি।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী এবং রাসূলের পরে যিনি মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মারা গেলেন। তার জন্যও কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা হয়নি। এরপর উমার, উসমান এবং আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম শহীদ হলেন। তারা সবাই রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এরপরে মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তাদের জন্যেও কোনো রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা হয়নি।
তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণ দুনিয়া থেকে চলে গেলেন, অথচ তাঁদের উত্তরসূরী তাবেঈগণ তাঁদের জন্য কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেননি। অতঃপর মারা গেলেন বিভিন্ন তাবেঈগণ এবং তাঁদের পরে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে থেকে যাঁরা ইসলামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং মানুষের হিদায়াতের ইমাম ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব, আলী ইবনুল হুসাইন (যাইনুল আবেদীন) আর তার পুত্র মুহাম্মদ ইবন আলী, উমার ইবন আব্দুল আযীয, আয যুহরী, ইমাম আবু হানিফা ও তার দুই ছাত্র, ইমাম মালেক ইবন আনাস, আল আওযায়ী, আস সাওরী, ইমাম আশ শাফেঈ, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহি সহ অসংখ্য সুবিখ্যাত ও হিদায়াতের ইমামগণের মৃত্যুতে মুসলিমগণ কোথাও কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেননি।
যদি এ কাজটি আমাদের জন্য কল্যাণকর বা সাওয়াবের হতো, তাঁহলে আমাদের পূর্ববর্তী নেককারগণ সবার আগে পালন করতেন। জেনে রাখুন, তাঁদের পথে চললেই রয়েছে আমাদের জন্য কল্যাণ আর তাঁদের বিরোধিতায় রয়েছে যাবতীয় অকল্যাণ ও অনিষ্ট।
ইতোপূর্বে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আমাদের পূর্ববতী নেককার উত্তরসূরীরা (সালফে সালেহীন) শুধু নির্দিষ্ট দিনগুলোতে স্বামীর জন্য স্ত্রীর শোক পালন ব্যতীত অন্য কারো জন্য কোনো প্রকার শোক দিবস পালন না করা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের এ কাজটি ঠিক এবং যথার্থ।
আজকাল মানুষ বিভিন্ন রাজা বাদশাহ এবং রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুতে যে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে মানুষের কাজকর্ম বন্ধ রাখা হয় এবং মানুষ অন্যান্য বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তাছাড়াও এমন কাজটি করা দ্বারা কাফিরদের অনুকরণ ও অনুসরণ করা হয়। অতএব তাদের এ কাজটি ইসলামী শরী’য়ত বিরোধী কাজ।
আর এ আলোচনা দ্বারা জানা গেল যে, রাষ্ট্রপ্রধান ও মুসলিম নেতাদের ওপর ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য) হলো এ জাতীয় মৃত্যু শোক দিবস পালন না করে পূর্ববতী নেককার উত্তরসূরী (সালফে সালেহীন) সাহাবী ও তাদের অনুসারীদের পদ্ধতি ও পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা। তাই এ জাতীয় কোনপ্রকার শোক অর্থাৎ শার’ঈ দৃষ্টিতে ইসলামে রাষ্ট্রীয় শোক পালন জায়েজ নয়।
আলেমদের ওপর ওয়াজিব হলো এ জাতীয় শোক দিবস পালনের ব্যাপারে তারা মানুষকে সাবধান করে দিবেন এবং জানিয়ে দিবেন। ওয়াজিব নসিহত হিসেবে এবং নেক কাজ ও তাকওয়ার (আল্লাহ ভীতির) কাজে তাদেরকে সহযোগিতার অংশ হিসেবে।
যেহেতু আল্লাহ তায়ালার জন্য ও তাঁর কিতাবের জন্য এবং তাঁর রাসূল (সা.) জন্যে এবং মুসলিম ইমামদের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য নসীহত করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাই এই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম।
আমরা শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায (রহ.)-এর ফতোয়া এখানে তুলে ধরেছি। মূলত প্রসিদ্ধ প্রায় সকল ইমামগণ শারঈ দৃষ্টিতে ইসলামে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করার বিধান স্পষ্ট করে জায়েজ নয় উল্লেখ করেছেন।
একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে আমি চেষ্টা করেছি, আপনাদের কাছে ইসলামের এ অতি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়াটি তুলে ধরতে।
যদিও আমাদের দেশে নিয়মিত রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়ে থাকে এবং সব দলের নেতা কিংবা কর্মীরা সবাই খুব শ্রদ্ধার সাথে এ শোক পালন করে থাকেন। আমি তাদের সবাইকে সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়ে এ ফতোয়াটির মাধ্যমে জানাতে চাই, তাই ইসলামিক দৃষ্টিতে এ জাতীয় সকলপ্রকার শোক প্রদর্শন করা রাসূল (সা.)-এর সুন্নত পরিপন্থী কাজ। এর মাধ্যমে কখনেই মরহুমের আত্মা প্রশান্তি কিংবা সম্মান পায় না। বরং পরকালে আরও কষ্ট পায়। তাই একজন মুসলিম দাবিদার হিসেবে বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত।
মহান আল্লাহ তায়া’লা আমাদের দেশ বা রাষ্ট্রকে পবিত্র কুরআন ও সুন্নতের আলোকে পরিচালনার তৌফিক দান করুক, আমিন। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহের দৃষ্টিতে ইসলামে রাষ্ট্রীয় শোক পালন জায়েজ কিনা? সে সম্পর্কে শাইখ বিন বায (রহ.)-এর থেকে আহরিত উক্ত ফাতোয়াটি মূল লিংক থেকে পড়ে নিতে এবং ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন…।
তথ্য সহায়তাঃ
মন্তব্য লিখুন