প্রত্যেক মুমিন জীবনে বছরের শ্রেষ্ঠ মাস “পবিত্র মাহে রমজান”। মুসলিম উম্মাহর জন্য মহান আল্লাহ তায়া’লার রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর রমজান মাসের আগমণ ঘটে৷ রমজান মাসে আল্লাহ তায়া’লা এমন কিছু বিশেষত্ব রেখেছেন যা অন্য কোন মাসের তুলমায় শ্রেষ্ঠ ও মহিমান্বিত। তাই প্রত্যেক মুসলিম উম্মাহর এই মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে রাখা আবশ্যক বলতে পারি। কেননা রমজান মাসে ইবাদত বন্দেগির ফালাফল ও পুরস্কার অন্য সকল মাসের চেয়ে বেশি এবং ফজিলতপূর্ণ। তাই আসুন একনজরে জেনে আসি কেন বছরের শ্রেষ্ঠ মাস পবিত্র মাহে রমজান? এবং পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসে এ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে কি বলা হয়েছে?
পবিত্র মাহে রমজান সম্পর্কে আল-কুরআন ও সহিহ হাদিসঃ
পবিত্র মাহে রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণ প্রত্যেক মুসলিমের আমলের জন্য সবচেয়ে সেরা সময় বলা যায়। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও নেকি বৃদ্ধির মাধ্যমে ইবাদতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার উত্তম মাস। রমজান মাস আল্লাহর সমীপে নিজেকে সৌভাগ্যবান করে নেয়ারও সর্বোত্তম মাস। অন্যান্য সকল মাসের তুলনায় রমজান মাসে সকলপ্রকার ইবাদতের ফজিলত বহুগুণে বেশি ও মর্যাদা সম্পন্ন হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এই মাসের অসংখ্য ফজিলত ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। আমরা এসম্পর্কে কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করছি।
কুরআন অবতীর্ণের মাস পবিত্র মাহে রমজান:
মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর তায়া’লার শ্রেষ্ঠ করুণা, দয়া ও হিদায়াতের শ্রেষ্ঠ কিতাব আল-কুরআন এই রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসটি হলো পবিত্র কুরআন অবতীর্ণের মাস।
মহান প্রভু আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“রমজান মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন এ সময় অবশ্যই রোজা রাখে।”(সূরা বাকারা-১৮৫)।
মহান আল্লাহ তায়া’লা রমজান মাসে যেহেতু পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। তাই আমাদের জন্য পবিত্র কুরআন যেমন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বানী ও কিতাব, ঠিক তেমনি কুরআন নাজিলের মর্যাদায় বছরের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান মহিমান্বিত ও সম্মানিত।
পবিত্র মাহে রমজান রমজান হলো লাইলাতুল কদরের মাস:
হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাত হলো লাইলাতুলকদর। আর আমরা একমাত্র রমজান মাসেই লাইলাতুল কদরের মহিমা ও সৌভাগ্য লাভ করে থাকি। তাই মহান আল্লাহ তায়া’লা রমজান মাসের ফজিলত ও মহিমা বৃদ্ধি করেছেন লাইলাতুল কদরের মাধ্যমে। কদরের এই রাতে মানুষের ভুল ও পাপসমূহ ক্ষমা করা হয় এবং ইবাদতে বহুগুণে সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়।
মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন-
“নিশ্চয় আমি এটা (কুরআন) শবেকদরে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো শবেকদর কী? শবেকদর এক হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। সে রাত আদ্যোপান্ত শান্তি-ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।”(সূরা কদর : ১-৫)।
সূরা কদরের তাফসির পাঠ করলে এ সম্পর্কে আমরা আরো বিস্তারিত জানতে পারবো। তাই সম্মানিত পাঠকদের সূরা কদরের তাফসির পাঠ করার অনুরোধ রইল।
জাহান্নামের দরজা বন্ধ করার মাস:
রছরের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান এর মর্যাদায় মহান আল্লাহ তায়া’লা এই মাসে জাহান্নামের সকল দরজা বন্ধ করে দেন৷ অর্থাৎ এই মাসে আল্লাহর তায়া’লা কাউকেই জাহান্নামের আযাবে ফেলেন না অথবা সকল প্রকার শাস্তি দেওয়া বন্ধ রাখেন।
এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন-
“রমজান মাস আগমন করলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়।”(সহিহ মুসলিম)
যেহেতু রমজান মাসে শয়তানকে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়৷ তাই এমাসই উত্তম মাস নিজেকে সংশোধনের ও তাকওয়া অর্জনের। কেননা শয়তান এ মাসে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে না, যেমনটি শয়তান অন্য মাসে করে থাকে।
রমজান জাহান্নামিদের মুক্তিদানের মাস:
রমজান মাসের মর্যাদায় আল্লাহ তায়া’লা জাহান্নামের কঠিন আযাব ও ভয়াবহতা থেকে পাপি বান্দরের ক্ষমা ও মুক্তি দিয়ে থাকেন। এ সম্পর্কে আবু সাইদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে রাসূল (সা.) বলেছেন-
“আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের প্রতিদিন ও রাতে জাহান্নামিদের মুক্তি দেন। রমজানের প্রতিদিন ও রাতে মুসলমানের দোয়া কবুল করা হয়।”(মুসনাদে আহমদ)
তাই আমাদের রমজানের প্রতিটি রাতে মহান আল্লাহর তায়া’লার ইবাদত ও ক্ষমা প্রর্থনা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন।
বান্দার গোনাহ মাফ হওয়ার মাসঃ
পবিত্র মাহে রমজান এর ফজিলত ও মর্যাদা এবং বান্দার মাগফিরাত সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন-
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা পালন করবে, তার পেছনের সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবে আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, তারও পেছনের সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।” (সহিহ বুখারি)
অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
“বান্দা কবিরা গোনাহে লিপ্ত না হলে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে অন্য জুমা এবং এক রমজান থেকে অন্য রমজান তার মধ্যবর্তী গোনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায়।”(সহিহ মুসলিম)
পবিত্র মাহে রমজান হলো জান্নাতে লাভের মাসঃ
রমজান মাসের ফজিলত ও মর্যাদায় মহান আল্লাহর তায়া’লা এ মাসে জাহান্নামের সকল দরজা বন্ধ করে দেন এবং জান্নাতের সকল দরজাগুলো খুলে দেন। ফলে অসংখ্য জাহান্নামিকে তিনি ক্ষমা করে জান্নাত দান করেন এবং অগণিত বান্দাদের জান্নাতের দিকে আহবান করেন অর্থাৎ জান্নাত লাভের সুযোগ করে দেন।
হযরত জাবের ইবনে আবদুুল্লাহ (রা.) হতে এ সম্পর্কে একটি হাদিসে তিনি বলেন-
“এক ব্যক্তি নবী করিম সা:কে জিজ্ঞাসা করলেন, যদি আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি, হালালকে হালাল মনে করি, হারামকে হারাম জ্ঞান করি এবং এসবে কোনো বৃদ্ধি না ঘটাই, তাহলে কি আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব? নবী সা: বললেন, হ্যাঁ- পারবে। লোকটি বলল, আল্লাহর শপথ! আমি কোনো কিছু বৃদ্ধি করব না।”( সহিহ মুসলিম )
রমজান মাসের রোজা পালন করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়া’লা বন্দার জন্য জান্নাতে সম্মান বৃদ্ধি করেন। মহানবী (সা.) বলেছেন-
“জান্নাতে এমন ঘর রয়েছে, যার বাইরে থেকে ভেতর এবং ভেতর থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। একজন গ্রাম্য সাহাবি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই ঘর কার জন্য? নবী (সা.) উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি উত্তম ও ভালো কথা বলে, মানুষকে খাবার দান করে, নিয়মিত রোজা পালন করে এবং মানুষ যখন রাত্রে ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় করে (তার জন্য এই ঘর)।” (জামে তিরমিজি)।
এ মাসে হজের সওয়াব লাভের মাস:
বছরের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান মাসে উমরা পালন করা, অন্য মাসে হজ পালন করার সমান সওয়াবের হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
“নবী কারিম (সা.) হজ সম্পন্ন করে ফিরে এসে উম্মে সিনান নামক আনসারি মহিলা সাহাবিকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমাদের সাথে হজ করলে না কেন? মহিলা সাহাবি বললেন, আমাদের দু’টি উট। আমার স্বামী একটি উটে হজে গমন করেছেন। আরেকটি আমাদের জমিনে পানি দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। (এ জন্য আমি আপনার সাথে হজে যেতে পারিনি) নবী (সা.) বললেন, ‘তুমি রমজান মাসে উমরা হজ আদায় করে নিও। রমজান মাসে উমরা আদায় করা মূল হজ আদায়ের মতো অথবা আমার সাথে হজ আদায় করার মতো।”(সহিহ বুখারি)
রমাজনে ইফতার করানোর ফজিলতঃ
পবিত্র রমজান মাসে অন্যকে ইফতার করানোর বিরাট ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
“যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সেও রোজাদারের মতো সওয়াব পাবে। এক্ষেত্রে রোজাদারের সওয়াব একটুও হ্রাস করা হবে না।”(জামে তিরমিজি )
এই হাদিসটি প্রমান করে এটা আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ যে, অন্যকে ইফতার করানোর মাধ্যমে আমরা অতিরিক্ত একটি পুরো সিয়ামের সওয়াব লাভ করতে পারি। অর্থাৎ একদিনে একাধিক সিয়ামের সওয়াব লাভ করার বিরাট সুযোগ। সুবহানাল্লাহ।
রমজান সুপারিশ লাভের মাসঃ
কিয়ামতের কঠিন পরিস্থিতিতে সিয়াম ও পবিত্র কুরআন আমাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে এবং জান্নাতে নিয়ে যাবে। এ মর্মে একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
“রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে খাবার ও শারীরিক চাহিদা থেকে দিনের বেলায় বিরত রেখেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে ঘুমানো থেকে বিরত রেখেছিলাম। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। সুতরাং রোজা ও কুরআনের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।”(মুসনাদে আহমাদ )
তাই রমজান মাসের সিয়ামগুলো ঠিকমতো পালন করা এবং দিনে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। আর রাত্রিবেলা নফল সালাতে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ফজিলতের কাজ যা লংংললপ্রমাণিত।
রমজান শহীদের সমমর্যাদা লাভের মাসঃ
হাদিস শরিফে বছরের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান এর ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে আমর ইবনে মুররা আল জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে-
“কজায়া গোত্রের এক ব্যক্তি নবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! যদি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দেই, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করি, জাকাত আদায় করি, রমজান মাসে রোজা পালন করি, তাহলে আমাকে আপনি কোন দলের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন? নবী মুহাম্মাদ (সা.) উত্তর দিলেন, ‘তোমাকে আমি সিদ্দিকিন ও শহীদদের ভেতরে গণ্য করি’।”( সহিহ ইবনে খুজাইমা)
সুতরাং রমজান মাস একটি বিরাট ফজিলতপূর্ণ ও মর্যাদার সম্পন্ন মাস। মহান আল্লাহর তায়া’লা এ মাসে বান্দার জন্য তাঁর সকলপ্রকার দয়া, রহমত ও ক্ষমা এতো বেশি নাজিল করে থাকেন, যা অন্য সকল মাসের চেয়ে বহুগুণে বেশি৷ তাই আমারা কেউ রমজান মাসের ফজিলত ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হলে তা হবে আমাদের জন্য চরম দূর্ভাগ্যের।
বছরের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান সম্পর্কে এতো সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা কখনোই সম্ভব নয়৷ তাই নির্ভরযোগ্য প্রসিদ্ধ কিতাব ও তাফসির পড়ার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করবো। বিশেষ করে রমজান মাস হলো পবিত্র কুরআন নাজিলে মাস। তাই আমাদের সকলের এ মাসে বেশি বেশি করে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত এবং বুঝে পড়ার দিকে গভীর মনোনিবেশ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী।
পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহর তায়া’লার মহান নিয়ামত। আল্লাহ তায়া’লা আমাদের সকলকে রমজানের পবিত্র রক্ষা ও মর্যাদা লাভের তৌফিক দান করুক। আমিন।