টানা চতুর্থ বারের মত বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে “ফিনল্যান্ড“। ২০২১ সালের ২০ মার্চ প্রকাশিত জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট মতে ইউরোপের এ দেশটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের উপর বেশকিছু জরিপ চালানোর পাশাপাশি অন্যান্য আরও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ রিপোর্টটি তৈরি করা হয়৷ তবে ২০২১ এর রিপোর্ট তৈরিতে নতুন কয়েকটি বিষয় যেমন: কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নাগরিকদের মানসিক অবস্থা, এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপ কিংবা দেশের সরকারের ভূমিকা ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট মূলত জাতিসংঘের একটি প্রকাশনা যা বিশ্বের দেশ ও মানুষের জীবন পর্যালোচনা করে থাকে। এ রিপোর্টে থাকে বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং জীবনযাত্রার মানের ক্রমানুসারে প্রকাশিত তালিকা যা কিছু নির্দিষ্ট দিক বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়। প্রাথমিক রিপোর্টটির জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয় গ্যালাপ ওয়ার্ল্ড পোলের সাহায্যে। পরবর্তীতে তালিকা তৈরির জন্য নির্দিষ্ট সদস্যদের নিয়ে গঠিত দল সে তথ্য বিশ্লেষণ করে ফাইনাল রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট জনসাধারণের জন্য প্রকাশিত হয় তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে।
প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের পহেলা এপ্রিল। ২০১৩ তে দ্বিতীয় এবং ২০১৫ তে তৃতীয় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সাল থেকে একে বার্ষিক রিপোর্ট আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ২০ মার্চ রিপোর্ট প্রকাশের দিন ধার্য করা হয়। মূলত ২০ মার্চ জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ডে অব হ্যাপিনেসকে উদ্দেশ্য করে দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের বাল্টিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত ফিনল্যান্ড। দেশটির মোট আয়তন ৩,৩৮,৪৫৫ বর্গ কিলোমিটার এবং বর্তমান জনসংখ্যা ৫৫,৩৬,১৪৬ এবং মোট জনসংখ্যার ৩.৪% বিদেশি জনগণ। অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাশিয়ান, সুইডিশ ও এস্তোনিয়ান নাগরিক। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৪০,১৯৭ মার্কিন ডলার। হেলসিংকি ফিনল্যান্ডের রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্তর্ভুক্ত এ দেশটির সরকারি নাম ফিনল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। তবে ফিনিশ নাগরিকরা তাদের দেশকে “সুওমি” বলে থাকে যার অর্থ হ্রদ ও জলাভূমির দেশ।
ফিনল্যান্ডের রয়েছে দীর্ঘদিনের শাসিত হওয়ার ইতিহাস। ৭০০ বছর সুইডেনের অধীনে শাসিত হয় এখানকার সাধারণ মানুষ। এরপর ১৮০৯ সালে রুশদের করায়ত্ব হয় ফিনল্যান্ড। পরবর্তী ১০০ বছরেরও বেশি সময় চলে রুশ শাসন। রুশ বিপ্লবের ফলস্বরূপ ১৯১৭ সালে দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে ফিনল্যান্ড।
ফিনল্যান্ড গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র। এ দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি দেশটির প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি “হেড অব স্টেট অব ফিনল্যান্ড” হলেও বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তার ক্ষমতা ব্যাপক পরিসরে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি শাউলি নিনিস্তো এবং প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন। ফিনল্যান্ড সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সকল শ্রেণির জনগণের প্রতি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সকল নাগরিকের অধিকার আদায়ে সচেতন এই রাষ্ট্র।
ফিনল্যান্ডের সরকারি ভাষা ফিনিশ এবং সুইডিশ। ৮৭.৩% জনগণের প্রধান ভাষা ফিনিশ। এই ভাষাটি অনেকাংশে ক্যারেলিয়ান এবং এস্তোনিয়ান ভাষার মতই। ফিনিশ এবং সুইডিশ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ভাষায় এখানকার মানুষ কথা বলে থাকে।
আরও পড়ুনঃ
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্ব সেরা, নেই হোম ওয়ার্ক ও পরীক্ষা
লুক্সেমবার্গ: বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রের জানা অজানা নানা তথ্য!
স্বপ্নের ভূবণ গ্রীনল্যান্ড এর আত্ম পরিচিতি
অসাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ফিনল্যান্ড সারা বিশ্বে পরিচিত। এ দেশের সরকারের মতে শিক্ষা জনগণের একটি অধিকার এবং ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা বিনামূল্যে শিক্ষা লাভ করে থাকে। প্রাথমিক স্কুলে ৬ বছর এবং মাধ্যমিক স্কুলে ৩ বছর পড়াশোনা করা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। উচ্চশিক্ষার জন্যও ফিনল্যান্ডে রয়েছে বিস্তর সুযোগ সুবিধা। এখানে রয়েছে অসংখ্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল। ইউরোপের যে দেশগুলোতে টিউশন ফি ছাড়াই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যায় ফিনল্যান্ড তার মধ্যে অন্যতম। এমনকি এখানে অভিবাসীদের ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের ভাষা শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে।
প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি রাষ্ট্র ফিনল্যান্ড। এখানে রয়েছে ঘন সবুজ বনের প্রাচুর্য, প্রাচীর ঘেরা অসংখ্য প্রাসাদ এবং অগণিত হ্রদ। বনভূমি এদেশের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ যাকে ফিনল্যান্ডের “সবুজ সোনা” বলে অভিহিত করা হয়। কয়েক হাজার বছর আগেও নিম্নভূমির এ অঞ্চলটি বরফে ঢাকা ছিল। অথচ বর্তমানে এর সৌন্দর্য পৃথিবীতে অন্যতম স্থান অধিকার করে নিয়েছে। মেরু অঞ্চলে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় সবসময়ই দিন থাকায় ফিনল্যান্ডকে “মধ্যরাতের সূর্যের দেশ” বলা হয়।
২০২১ সালের মার্চে প্রকাশিত জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড। এটি ছিল ফিনল্যান্ডের চতুর্থ বারের মত এ জরিপে প্রথম স্থান অধিকার করার ঘটনা। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং অ্যাট বিজনেস ফিনল্যান্ডের সিনিয়র ডিরেক্টর হেলি জিম্যানেজ বলেন- “ফিনিশ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য প্রথম দেখাতেই ধরতে পারা যায় না। এটি আমাদের মনের এক সুগভীর অনুভূতি। সুখী থাকা আমাদের জন্য পরাশক্তির মত এবং এর মানে হচ্ছে আমরা জীবনকে একটি স্পর্শ বা মূল্যবান কিছু হিসেবে গ্রহণ করি যা আমাদের এমন অস্থিরতার সময়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে”।
ফিনল্যান্ড দীর্ঘদিন যাবত নিজেকে সুখী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এর অপার সৌন্দর্য এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর সরকার ব্যবস্থাপনার বদৌলতে। এ দেশের সুখকে অনুভব করে দেখতে পর্যটকদের বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছে দেশটির পর্যটন বিভাগ। তাদের মতে এখানে এসে কেউ যদি এর ঘন সবুজ বন এবং হ্রদের সম্মুখে স্বস্তিকর কিছু সময় কাটিয়ে যেতে পারে, তবে তারা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবে।
এছাড়াও ফিনল্যান্ডের জনগণের জীবনযাত্রা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক স্বস্তিদায়ক। এখানে রয়েছে সঠিক গনতন্ত্র, নিম্ন দুর্নীতির হার, স্বাস্থ্য সেবার অসাধারণ ব্যবস্থা এবং অভাবনীয় স্বাধীন জীবন যাপনের সুযোগ। এমনকি এদেশের বেশিরভাগ মানুষ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রেও সুখী। গৃহহীন জনগণের সংখ্যা ফিনল্যান্ডে খুবই কম। নারী পুরুষের সমতার ব্যাপারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে এদেশ। এসব কারণেই মূলত এদেশের মানুষ পৃথিবীর সুখী দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে।
মানুষের জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানসিক প্রশান্তি এই সুখের পেছনের রহস্য। আর ফিনল্যান্ড এমন একটি দেশ যেখানে এর সরকার যেমন জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য কাজ করে যাচ্ছে তেমনি এর অপার সৌন্দর্যও এখানকার মানুষকে রাখছে প্রফুল্ল। এ কারণেই ফিনল্যান্ড টানা চতুর্থ বারের মত বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হওয়ার গৌরব অর্জনে সক্ষম হয়েছে।